Friday, October 4, 2019

জন্ম-মৃত্যু ও মানুষের ধর্মপথঃ(মুহাম্মাদ মহসীন ভূঁইয়া)


জন্ম-মৃত্যু ও মানুষের ধর্মপথ

মানুষের আত্মা হলো পবিত্র আলো, সে আলো  সৃষ্টির উৎস স্রষ্টার হুকুম থেকে আসে, আত্মা এমন এক আলো যেখানে আলোর স্রষ্টা থাকে। প্রতিটি মানুষ আলোর বাহক বা ধারক, আলোর অবস্থান থাকলেও আকার নেই, সুতারাং আত্মার আকার নেই, আত্মা নিরাকার, অর্থাৎ মানুষের চিন্তায় বা ধারণায় বা জ্ঞানের সীমানায় আত্মার কোন আকার নেই। সেভাবে বলতে গেলে আলোর উৎস বা স্রষ্টারও আকার নেই সৃষ্টির ধারণা বা জ্ঞান চিন্তার সীমানায়। আলোর সাথে প্রদীপের যেমন সম্পর্ক আছে উৎস মূলে, ঠিক তেমনি মানুষের আত্মার সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক । মানুষ নিজ আত্মার আলোর মাধ্যমে  স্রষ্টার ধারক বা বাহক। মানুষ কষ্ট পেলে আত্মাও কষ্ট পায়, আত্মা কষ্ট পেলে স্রষ্টাও কষ্ট পায়। মানুষ আনন্দ পেলে আত্মা আনন্দ পায়, আর আত্মা আনন্দ পেলে আত্মার আলোতে থাকা স্রষ্টা ও আনন্দ পায়। সুতারাং
মানুষকে কষ্ট দিলে স্রষ্টা কষ্ট পায়, আনন্দ দিলে স্রষ্টা আনন্দ পায়।
মৃত্যুঃ
জন্ম আর মৃত্যুর ফায়সালা জমিনে নয়, আসমানে হয়। জন্মের মত মৃত্যুটাও মানুষকে স্বাভাবিক নিয়মে মেনে নিতে হয়। কার কখন মৃত্যু হবে, কেউ বলতে পারবেনা। আমার বা আপনার, আমাদের সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু মানে পৃথিবী থেকে প্রস্থান বা চিরবিদায়। আজ পর্যন্ত যত মানুষ দুনিয়াতে এসেছে, তাদের সবাইকে চলে যেতে হবে। সৃষ্টিশীলের সৃষ্টিনাশ হবেই। এটা আস্তিক বা নাস্তিক সবাই একবাক্যে বিশ্বাস করে এবং মানে। এখন পর্যন্ত কোন নাস্তিক বা মানুষ বা অন্য সৃষ্ট জীব এটা বলেনি যে, আমি আমৃত্যু। 
স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক, কালে বা অকালে মৃত্যু আসবেই। মৃত্যুকে নিয়ে সবারই একটা কৌতূহল আছে, যদিও মরে এর সাদ বা জানার ইচ্ছা কারও নেই। কথায় আছে সবাই বেহেশতে বা স্বর্গে যেতে চায়, কিন্তু কেউ মরতে চায়না। অথচ বেহেশত বা স্বর্গ প্রাপ্তি হয় মৃত্যুর পর।
এই মৃত্যু আসলে কি ?
এর শতভাগ সঠিক ও বাস্তব জ্ঞান পাওয়া যেত, যদি মৃত্যুর পর আবার জীবিত হয়ে দুনিয়াতে আসা যেত। কিন্তু এটা কি সম্ভব ?  এক কথায় অসম্ভব। মৃত্যুর পর দুনিয়াতে আবার ফিরে আসবে এই আশায় কেউ কি মরতে চাইবে ?  মনে হয় কেউ চাইবেনা। মানুষ আল্লাহ বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক বা না করুক। এটা সবাই বিশ্বাস করে যে, মৃত্যুর পর আবার মানুষ হয়ে একই আকারে আর আসবেনা। পৃথিবী থেকে মৃত্যুর মাধ্যমে চিরবিদায় হতে হয়। যদি আসার সুযোগ থাকতো, তাহলে অন্তত মুসলমানদের নবীরা বা হিন্দুদের দেবতারা বা ঈশায়ীদের যীশু সবার আগে আসার সুযোগ পেত। এদের কাউকে যেহেতু স্রষ্টা বা দুনিয়ার নিয়ম মৃত্যুর পর আবার আসার সুযোগ দেয়নি। আমরাতো সাধারণ মানুষ। আমাদের কোন সৎ কর্মের জন্য এই সুযোগ দিবে ? মৃত্যু হলো এমন এক ধ্বংস বা বিনাশ, যার মাধ্যমে দেহের থেকে প্রাণের বা আমার থেকে আমির প্রস্থান হয়। সৃষ্টিজগতে আমার দেহ পরে থাকে আর আমি প্রাণ দেহ ত্যাগ করে আগের জগতে চলে যাই।
স্রষ্টাঃ
স্রষ্টার আসন তৈরি হয়েছে জন্ম-মৃত্যুর মাধ্যমে। জন্ম আর মৃত্যু একজন সৃষ্টিকারী ও সৃষ্টির রুপ যেমন প্রমাণ করে, ঠিক তেমনি ভাবে স্রষ্টাতত্ত্বের আদর্শিক প্রমাণ তৈরি হয়। যদি জন্মই অনন্ত হয়, মৃত্যুর বিধান চিরতরে বিনাশ হয়, তাহলে স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টির কাছে থাকবেনা। প্রতিটি সৃষ্টি নিজেই স্রষ্টার আসনে বসবে। প্রত্যেক সৃষ্টি নিজেই হবে একজন স্রষ্টার দাবিদার। মৃত্যুহীন পৃথিবী জন্মহীন স্রষ্টার সমান। প্রাণের জন্মই হয় মৃত্যু জন্য, জন্ম আর মৃত্যর রহস্য জানা সৃষ্টির জন্য নয়, এটা একান্তই সৃষ্টি সীমার বাহিরে। জন্মের মাধ্যমে প্রাণ বা আত্মার সৃষ্টি হয়না, দেহের সৃষ্টি হয়। প্রাণের বিনাশ সৃষ্টি জগতে অসম্ভব। পৃথিবী নিজেই সৃষ্ট, তার নিজের মৃত্যু বা ধ্বংস অনিবার্য। প্রাণের সৃষ্টি বা জন্ম স্রষ্টালয়ে হয়েছে, মৃত্যু কি করে  সৃষ্টিলয়ে হবে  ?  যার সৃষ্টি হয়, সে স্রষ্টার সৃষ্টিকে মৃত্যু দিতে পারেনা। জন্ম আর মৃত্যু হলো একান্ত স্রষ্টার নির্দেশ বা আদেশ।  আত্মার বিনাশ সৃষ্টিশীল পৃথিবীতে নয়, বিনাশ হবে সৃষ্টির বাহিরে স্রষ্টার জগতে। প্রাণের জন্মে প্রাণীর নিজ ইচ্ছা বা ক্ষমতা যেমন নেই, প্রাণীর প্রাণ বিনাশের ক্ষমতা তার অধীনে নয়, সৃষ্টিশীল পৃথিবী হলো আগমন আর প্রত্যাবর্তনের একটি চক্রের কাল। এখানে তৈরি বা সৃষ্টি নয়, শুধু আগমন আর প্রত্যাবর্তন হয়। সৃষ্টি যেমন সৃষ্টি করতে পারেনা, তেমনি ভাবে সৃষ্টি চিরতরে বিনাশ বা ধ্বংস করতে পারেনা। সৃষ্টি বা জন্ম যেমন চির অজানা রুপ, মৃত্যু বা চির বিনাশ সৃষ্টিজগতে অজানাই থাকবে। প্রাণের রুপ দেহে স্থায়ী নয়, প্রাণ হলো স্রষ্টার হুকুম আর দেহ হলো প্রাণের ধারক। প্রাণ আর দেহ এক নয়, দু'টার সৃষ্টি এক জগতে হয়নি, এক সময়ও নয়। দেহ তৈরি পৃথিবীতে, এর বিনাশও পৃথিবীতে। আর প্রাণ বা আত্মার সৃষ্টি যেহেতু পৃথিবীতে হয়না, বিনাশ কি করে হবে ?  দেহের জন্ম পৃথিবীতে, মৃত্যুও পৃথিবীতে হয়। প্রাণ বা আত্মার জন্ম দেহের অজানা, এর চিরবিনাশ বা চিরতরে মৃত্যুও অজানা। এটা অস্থায়ী দেহে স্থায়ী নয়। পৃথিবীতে আত্মার জন্ম হয়না, দেহের সৃষ্টি হয় এবং দেহের মৃত্যু হয়, আত্মার মৃত্যুও হয়না। আত্মা দেহের ভিতর আসে এবং দেহের মৃত্যুর মাধ্যমে আত্মা দেহ ত্যাগ করে। দেহ হলো প্রাণহীন খাচা। এটা সৃষ্টির শুরুতে প্রাণহীন আবার শেষেও প্রাণহীন হয়ে বিনাশ হয়। দেহের মৃত্যু হয় পৃথিবীতে, প্রাণ বা আত্ম পৃথিবীতে মৃত্যু হয়না। প্রাণ হলো স্রষ্টার রুপের ধারক,দেহ হলো সৃষ্টির আকার বা রুপ। দেহ বস্তুগত সৃষ্টি, প্রাণ অবস্তুগত শক্তি। দেহের আকার আছে, প্রাণ নিরাকার। দেহ প্রাণহীন হলে মৃত, প্রাণ দেহহীন হলেও মৃত নয়। দেহের অস্তিত্ব পরিবর্তনশীল, প্রাণের নিরাকার রুপ পরিবর্তনশীল নয়। প্রাণের মৃত্যু হবে প্রাণের জন্মের মতই স্রষ্টার হুকুম বা নির্দেশে। প্রাণ দৃষ্টিপটের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শক্তি, দেহ হলো দৃষ্টিগোচর হওয়া মাংসপিণ্ডের আকার। দেহের মৃত্যুতে প্রাণের অস্তিত্ব বিনাশ নয়, দেহ বিনাশ হয়।
সময়ঃ
সময় আর নদীর বহমান স্রোত ঘড়ির কাটার মতই চলমান। এরা কারো জন্য অপেক্ষা করেনা।পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর স্থির হতে পারে, বন্ধ হতে পারে মানুষের তৈরি আয়োজন। সময়, বহমান নদীর স্রোত আর ঘড়ির কাটা চলবেই। অন্ধজন আলোহীন, তাই বলে সূর্যের আলো কোনদিন বন্ধ হয়নি, হবেওনা। পৃথিবীর শুরু যেহেতু আছে, শেষও হবে একদিন। তবে সময়ের শুরু নেই, শেষও নেই। সময় হলো স্রষ্টার অস্তিত্বশীলতার পথিক বা সিম্বল।  সময়ের মহাকালে আজকের পৃথিবীর সম্পূর্ণ ইতিহাসের ছবিটাকে আমি এক সেকেন্ডের হাজার কোটি ভাগে এক অংশ মনে করতে পারি, বা তার চেয়ে আরো কোটি কোটি গুণ ছোট। অর্থাৎ মানব রচিত সর্বছোট সময়ের খন্ডটি হলো পৃথিবীর সমস্ত জীবনের আয়ুরেখা।  পৃথিবী হলো মহাকাশের হাজার কোটির ছায়াপথ পরিবারের মাঝারি ধরনের একটি ছায়াপথের সদস্যের অন্তর্ভুক্ত।  এক ছায়াপথে হাজার কোটি নক্ষত্র থাকে, আর ঐ নক্ষত্রের একজন হলো সূর্য। সূর্যের মহালয়ে ঘূর্ণিত একটি মাঝারি মানের অংশ হলো পৃথিবী। যার বিশাল পরিধীতে সাতশত কোটি মানুষসহ সকল প্রাণীজগৎ বসবাস করে। সাথে আছে প্রাণহীন মানব রচিত বিশাল কর্মযজ্ঞ।  আর এসবই হচ্ছে ঐ মহাকালে এক সেকেন্ডের অতি সূক্ষ্মতর সময়ে। আমি মনেকরি, সময় মানেই হলো স্রষ্টাতত্ত্বের শুরু,যার শুরু নেই, শেষও হবেনা। এই সময় হলো মহাকালের ঘড়ি। শুরু আর শেষ আছে সৃষ্টির, স্রষ্টার বা সময়ের শুরুও নেই আবার শেষও হবেনা। এটা চিরন্তন সত্য ও চিরস্থায়ী মহাকালের চলমান ঘড়ি। যার আকার লুকিয়ে থাকে নিরাকার সময়ের ভিতর।
দেহ খাঁচারঃ
প্রচলিত প্রবাদ আছে-শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু, এই কাল বা সময়টি হলো একজীবন।  পৃথিবীর এক জীবনে একবার জন্ম এবং একবারই মৃত্যু হয়। এই সময় একজন মানুষ স্বাভাবিক নিয়ম মতে, শিশুকাল, কিশোরকাল, তরুনকাল,যৌবনকাল এবং বৃদ্ধকাল হয়ে জীবনের শেষকালের সমাপ্তি হয়। আবার কিছু মানুষ কালের ভিতর অকালেও জীবনের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। সেটা হতে পারে জন্মের পরপর, অথবা মাঝামাঝি যেকোন সময়ে। মানুষ জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ে যে কাল অতিবাহিত করে তাকে এক কথায় জীবনকাল বলা হয়। কেন আমি বা তুমি এই পৃথিবীতে এসেছি ?
কিসের মোহে এখানে থেকে যেতে চাই ? জন্মের আগে কোথায় ছিলাম?
কোন আকারে ছিলাম ?  আমরা কি  নিরাকার ছিলাম ?  আমরা কি পৃথিবীতে আসার আগে অস্থিতহীন ছিলাম ?  এমন প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে। আমি কোন এক ধর্ম মতের যুক্তিকে যদি তুলেধরি, তাহলে অন্য ধর্মের অনুসারীরা হয়তে মানতে চাইবেনা।  আবার যারা ধর্মই মানেনা, তারা বলবে, জীবনের আগে শূন্য আবার পরেও শূন্য। আমি আমার মতামত বলবো, আপনাকে মানতে হবে বা অমান্য করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাদকতা নেই। আমি মনে করি,  মানুষ হিসেবে মতামত দেওয়ার অধিকার আমার রয়েছে। এই পৃথিবীটা আমার বা আপনার বা শুধু মানুষের নয়। এখানে বাচাঁর অধিকার সকল সৃষ্টিকুলের। সবাই নিজ যোগ্যতা বা ক্ষমতার আলোকে বেঁচে থাকতে পারবে, এমনটা আমি মনে করি। জন্ম ও মৃত্যু বিচার করলে সকল সৃষ্টিকুল হলে আগমন ও প্রস্থানকারী, কেউ স্থায়ী অধিবাসী নয়। পার্থক্য শুধু আগে এসে আগে যায়, পরে এসে পরে যায়। বয়সের বড় হওয়াটা কারো যোগ্যতা বা ব্যক্তিগত গুণ নয়। এটা হলো নিয়ম, পৃথিবীতে আমার বড় যেমন কোটি কোটি সৃষ্টি রয়েছে, ঠিক তেমনি ছোটও রয়েছে। দুনিয়ার বা পৃথিবীর মাঝে ছোট- বড় আছে, কিন্তু আমাদের আত্মা বা রুহ বা আমার ভিতরের আমি বা তোমার ভিতরের তুমির মাঝে কি ছোট- বড় আছে  ?  'না' নেই। এটা একটা স্পীড বা শক্তি বা হুকুম বা আদেশ বা অদৃশ্য প্রোগ্রামের শুরু।যেমন 'আলো',  এটা কোথায় থেকে আসে আবার কোথায় চলে যায় ?  অথবা 'অন্ধকার'। আচ্ছা ধরুন, আপনি একটা অন্ধকার কক্ষে আছে,  দরজা জানালা বন্ধ। বাহিরের আলো ভিতরে আসতে পারছেনা। এখন আপনি একটা প্রদীপ জ্বালানোর কক্ষটি আলোকীত হলো। বলুনতো গহীনকালো অন্ধকার কোথায় চলে গেল?  সেতো এতক্ষন আপনার সাথেই ছিল। আবার আপনি যখন প্রদীপটির আলো নিবিয়ে দিবেন, সাথে সাথে রুমটি অন্ধকার হয়ে যাবে। হঠাৎ কোথায় থেকে এলো এই অন্ধকার ?  সেতো ছিলনা। আমি বলছি, বন্ধ ঘরে বা রুমে আলো আর অন্ধকারে মতই আমাদের প্রাণ বা রুহ বা আমার ভিতর আমি আসি +জন্ম) এবং চলে (মৃত্যু) যাই। আলো আর অন্ধকার যেমন আমরা চিনতে পারিনা, ধরতে পারিনা, রাখতে পারিনা, নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা এবং এর যেমন আকার বা বয়স নির্নয় করা যাবেনা, ঠিক তেমনি রুহ বা প্রাণেরও বয়স নেই। সে শুধু ঐ বন্ধ ঘরের ভিতরে আলো আর অন্ধকারের মত করে আসে, কিছুকাল থাকে, আবার চলে যায়। আমাদের শরীল হলো একটা অন্ধকার বন্ধখাঁচা, রুহ বা প্রাণ আলো হয়ে জন্ম নেয়, আবার অন্ধকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে চলে যায়।   আসার আগে এবং যাওয়ার পরে তার অবস্থান হলো একটি শক্তি বা হুকুমের আকারে। আলোকে যেমন অন্ধকার দিয়ে ঢেকে রাখা যায়না, রুহুকে তেমনি খাঁচা দিয়ে আটকে রাখা যায়না। যেই গতিতে এসেছে, সেই গতিতে চলে যায়।
ধ্যানে মিলবে পরম জ্ঞানঃ
ধ্যান হলো পেশিক্রিয়া আর স্নায়ুর ক্রিয়ার শিথিলায়নের মাধ্যমে আত্মনিমগ্ন হওয়া অর্থাৎ দেহ আর মনকে নিয়ন্ত্রণ করে অস্থির মনকে স্থির করা ও মনোযোগ একাগ্র করার প্রক্রিয়া।
ধ্যান হলো দেহ আর মনের শারীরিক ও মানসিক ব্যায়াম। এটা এমন এক যোগ ব্যায়াম, দেহ থেকে দেহের কাম এবং মনের থেকে মনের কামকে নিয়ন্ত্রণ করে এক দৃষ্টি ও লক্ষ্যে নীরবে বসে সুনির্দিষ্ট অনুশীলন। ধ্যানের মাধ্যমে একদিকে মনোযোগ, সচেতনতা, নিজের প্রতি ভালোবাসা, সৃজনশীলতা, সুস্থতা ও প্রেম বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে কপটতা, হিংসা, কামুকতা, লোভ, অহংকার ও অসুস্থতা দুর করে মনকে স্বেচ্ছায় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে এবং প্রশান্তি ও সুখানুভূতি বাড়ানোর পাশাপাশি ঘটায় অন্তরের মহান জাগরণ।
ধর্মীয় শাস্ত্রে ধ্যান বলতে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে, মনকে মুক্ত করে কোনো ঐশী শক্তিতে সমর্পিত হওয়া প্রভৃতি, ইসলাম ধর্মের নিজের ভিতর নিজেকে খোজার মাধ্যমে প্রভুর খোজ করা বা আপন পরিচয় সন্ধানের জন্য প্রভুকে সন্ধান করার উত্তম মাধ্যম হলো ধ্যান। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির আগে, যখন দুনিয়াতে কুরআন, নামায, ইসলামী শরীয়তের বিধি বিধান আসেনি, তখন তিনি আপন মনে নিজের ভিতরে নিজেকে খোজার মাধ্যমে প্রভুর সন্ধান করার জন্য হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান করতে এবং সেখানেই তিনি আপন প্রভুর ঐশি জ্ঞান লাভ করেন এবং মানবতার কল্যাণের জন্য প্রভুর আদেশ প্রাপ্ত হন। সুতারাং ধ্যান হলো দেহ মনের এমন একটি রেখা, যেখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মহা মিলন হয়।
মানব ইতিহাসে সুনির্দিষ্টভাবে ধ্যানের উৎপত্তি কবে হয়েছে, তা অজানা থাকলেও প্রত্নতত্ত্ববিদ ও গবেষকগণ একমত যে, ধ্যান প্রায় ৫০০০ বছর আগে উৎপত্তি লাভ করেছিল। ধ্যান চর্চার সবচেয়ে প্রাচীন দলিল পাওয়া যায় প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের বেদে।টাও ও বুদ্ধের ধ্যান পদ্ধতির বিকাশ ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ সালে।  খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০-১০০ সালে পতঞ্জলির যোগসূত্রে প্রণীত হয় যেখানে অষ্টাঙ্গা ধ্যানের বর্ণনা পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ – খ্রিষ্টাব্দ ২০০ সালে ভগবদ গীতায় লিখিত হয়। যেখানে যোগ বা ধ্যান এবং আধ্যাত্মিক জীবন যাপনের পদ্ধতি নিয়ে বর্ণনা রয়েছে। আবার মুসলমানদের ধর্ম গ্রন্থ আল কুরআনে নামায কে প্রভুর স্বরণে বান্দার ধ্যান বলা হয়েছে এবং গভীর রাতে প্রভুর জিকির বা স্বরণ নিয়েও আলোচনা হয়েছে এবং নবী মুহাম্মদ (সঃ) নিজে হেরা পাহাড়ের উপর গুহার ভিতরে রাত - দিনে একা একা নির্জনে বসে ধ্যান করতেন।  ৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে জাপানে প্রথম ধ্যান হল খোলা হয়। অষ্টাদশ শতকে ধ্যানের প্রাচীন শিক্ষার অনুবাদ পাশ্চাত্যে পৌঁছায়। বিংশ শতকে ধ্যানের বিভিন্ন মেথড উদ্ভাবিত হয়।
নিয়ম পদ্ধতির ভিন্নতা অনুসারে ধ্যানে প্রকারভেদ বিদ্যমান। উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকার হলঃ-
যোগ ধ্যান, অষ্টাঙ্গা ধ্যান, চক্রভেদে ধ্যান, সুফি ধ্যান ও রেচক পূরকে ধ্যান।
মানুষের আচরণঃ
মানুষ এমন একটি প্রাণী বা জীব, যার মান ও হুশ রয়েছে। আকারে পরিবর্তনশীল প্রতিটি বস্তুর জীবন আছে, তবে সকল জীবনের মান ও হুশ নেই। যাদের মান আর হুশ আছে তাদেরকে সমাজে মানুষ বলে। আজকাল আবার কিছু কিছু মানুষের ভিতরে অমানুষের আত্মা ভরকরে আছে, আকার ও আওয়াজে মানুষের মত হলেও,এরা আসলে মানুষ নয়। এদের চেতনা শক্তি কম, ন্যায় ও অন্যায় এর মাঝে পার্থক্য বুঝেনা। সত্য মিথ্যার ব্যবধান করেনা, নিজেদের পক্ষে হলে হাসে আর বিপক্ষে গেলে গলা উছিয়ে কাশে। অনেকে আবার অতি বুদ্ধির ডেকোর তুলে অতি প্রগতিশীলতা অভিনয় করে। মানুষকে বিচার করে ধর্ম,বর্ণ,জাতির ও নীতির পরিচয়ে। সমাজ ব্যবস্থায় আজকাল এমন মানুষের অবস্থান ব্যাপক উন্নত স্তরে।রাষ্ট্রের উপর তলা থেকে নীচ তলায় এখন মান ও হুশ বিহীন অভিনেতা মানুষের সংখ্যায়ই বেশি। মানুষের মানবিকতা অমানুষের স্তরে চলে এসেছে। নিজের প্রয়োজনে একজন অন্যজনকে দাসের মত ভাবতে লজ্জাবোধ করেনা। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র নিয়ে ভাবতে চায়না। জীবনের ধ্যান জ্ঞান নিজেকে নিয়ে, নিজের ভোগ ও সুখ নিয়ে। আত্মসুখ ও মনের শান্তির জন্য জগৎ জ্বালিয়েও এদের ভোগ মিঠেনা। আজকাল মানুষের বাহ্যিক রুপের সাথে শিকারি সিংহ ও হিংস্র হায়নার মানসিকতা যুক্ত হয়ে এক নতুন মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। এক কথায় বলতে পারেন, শিকারি পশুরমত হিংস্র মানুষ। কাক কাকের মাংস না খেলেও, মানুষ কিন্তু ঠিকই মানুষের মাংস খায়। এরা কুপিয়ে কুপিয়ে খায়, পিটিয়ে পিটিয়ে খায়, পায়ের তলা দিয়ে পিষ্টে মানুষ মেরে খায়, হাতুরি দিয়ে চেঁচে চেঁচে নিজ বন্ধুর মাংসও খায়। নীতির পার্থক্য বা ধর্মের পার্থক্যের জন্য মানুষ নিজ প্রজাতিকে হত্যা করে খায়। দল বা আদর্শের জন্য একজন অন্যজনকে প্রকাশ্যে হত্যা করে নৃত্য করছে আর ধ্বংস করছে মানবতা ও মানসিকতাকে। আদর্শ, ধর্মীয় তকমা ও প্রগতির চেতনায়  মানুষ হত্যা এখন স্বাভাবিক ও আইন সংগত ব্যাপার হয়ে গেছে। কেউ ক্ষমতায় থাকার জন্য মানুষের পোড়া মাংস খায়, আবার কেউ ক্ষমতায় আসার জন্য পোড়া মাংসের কাবাব খায়। স্বর্গ পাওয়ার আশায় মানুষ মানুষকে মেরে, মানুষকে কথার আঘাত দিয়ে সুখ পায় আবার কেউ কেউ স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি পেতে মানুষের উপর বোমা মারে। জগতের আধুনিক রুপ তৈরি করতে এক মানুষ অন্য মানুষকে দাস বানিয়ে কাজ আদায় করছে। আধুনিক সভ্যতার ইমারত গুলোকে আজ রক্ত মাংসের ইমারত মনে হয়। এক সভ্যতার স্থায়িত্বের জন্য অন্য সভ্যতাকে মুহূর্তেই ধ্বংস করে দিচ্ছে এ জগতের অসভ্য ও মাংস লোভী হিংস্র মানুষ গুলো। এখন মানুষ হিংস্র জানোয়ার থেকে নিরাপদ হলেও, অতি আধুনিক প্রগতিশীল হিংস্র মানুষ থেকে নিরাপদ নয়। সমস্ত পৃথিবীকে এরা নিজ সুখ ও শান্তির জন্য খোদার নরক বানাচ্ছে।  বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে শান্তির নিরাপদ শহরকে। এসব অমানুষদের বিষক্রিয়া এত মারাত্মক যে, আকাশ-বাতাস  বিষের আগুনে জ্বলছে। এদের নীতি আদর্শ বা ব্যবস্থার বিরোদ্ধে কথা বললে, আপনাকে শুয়রের পালের মত আক্রমণ করবে। প্রয়োজনে আপনাকে থামাতে গুম,খুন বা হত্যার পথে নামবে। এরা নিজের পথ ও মতের জন্য অন্যের বুকে চুরি চালায়। আজ সমাজ রাষ্ট্র বা বিশ্বে এদের হিংস্রতার জোয়ার বইছে। এদের হাত থেকে আমি, আপনি, আমরা বা আমাদের জীবন নিরাপদ নয়। এদের প্রগতি বা ধর্মীয় উন্মাদনায় ৭১ সালে গণহত্যা, ৭২ ও ৭৩ এর গুপ্ত হত্যা, ৭৫ এর কালো হত্যা, জেলহত্যা, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের হত্যা, বিডিআর হত্যা, জঙ্গিবাহিনী বোমা হামলা, শাপলা চত্তরের হত্যা ও ২৮ অক্টোবরের প্রকাশ্যে মানুষ হত্যাসহ রাজনীতির নামে বিনাবিচারে মানুষ হত্যা আজ সুস্থ সমাজকে অসুস্থ সমাজে পরিনত করেছে। এদের বাহিরের রুপ মানুষের আর ভিতরের রুপ জানোয়ারের।
ধর্ম চিন্তাঃ
মানুষের বিশ্বাস, মানুষ নিজের উপর যেই নিয়ম বা বিধান নিজে নিজে আরোপ করে, অর্থাৎ অন্যের বল প্রয়োগ বা প্ররোচনায় প্ররোচিত না হয়ে স্বেচ্ছায় নিজে উপর নিজে যে লিখিত বা অলিখিত নীতিমালা কায়েম করে তাকে ধর্ম বলে। কোন ব্যক্তি যখন নিজের উপর ইসলামের  বিধানে স্বেচ্ছায় কায়েম করে, তখন সে একজন ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয় এবং তার ধর্মীয় পরিচয় হয় মুসলিম। আবার কেউ যদি হিন্দু মত মেনে নেয়, তখন সে একজন হিন্দু ধর্মীয় অনুসারী হয়। অর্থাৎ এই মেনে নেওয়াটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় হতে হবে। আজকের পৃথিবীতে এভাবেই ইসলাম, হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, ঈসায়ীসহ শত শত মতবাদ বা বিশ্বাস মানুষ পালন করে। আবার একদল বিশ্বাসী আছে, যারা কোন নিয়ম বা বিধান কে মেনে চলতে চায়না। এরা হলো অবিশ্বাসী মতবাদে বিশ্বাসী,  এটাকেও আপনি একটা বিধান বা ধর্ম বলতে পারেন। যারা কোন নিদিষ্ট নিয়মে বিশ্বাসী নয়।
অতএব
তাহলে আমরা বলতে পারি-
ধর্ম হলো মানুষের স্বেচ্ছায় নিয়মের বিধানে বন্দি এমন এক জীবন ব্যবস্থা, যেখানে প্রত্যেক মানুষ নিজেকে অন্য শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে দেয়। আর যারা আত্মসমর্পণ করেনা, তারা হলো অবিশ্বাসী ধর্মীয় বিধানে বিশ্বাসী। যেহেতু প্রত্যেক মানুষ কোন না কোন একটি নিয়ম বা বিধানে বিশ্বাসী, তাই সকল মানুষ আস্তিক ধর্মীয় মতে বিশ্বাসী , মানুষ নাস্তিক হতে পারেনা। তবে কেউ ইসলামে আস্তিক, কেউ হিন্দুতে আস্তিক আবার কেউ বৌদ্ধ বা ঈসায়ী বা জৈনতে আস্তিক। কেউ স্রষ্টায় আস্তিক অথবা কেউ স্রষ্টায়হীনতায় আস্তিক।
মানুষ আত্মশুদ্ধি ও আত্মমুক্তির জন্য দুনিয়ার জীবনে যে পথ অনুসরণ করে চলে তাকে ধর্ম বলে। যে যেপথে বিশ্বাস করে, সে সেই ধর্ম পথের বিশ্বাসী বা অনুসারী। মানুষ ধর্মমত বা পথ পালন করার একমাত্র কারণ হলো আত্মশুদ্ধি বা আত্মমুক্তি।  ধর্ম কখনও অসৎপথ বা মতে মানুষকে পরিচালিত করেনা। সকল ধর্মের মানুষ চায় মুক্তি,শান্তি ও শৃংখলা।  ধর্ম চিন্তায় মানুষ হলো সত্যের অনুসন্ধানী ও সত্য প্রাপ্তি পথিক মাত্র। এখানে হিংসা, হানাহানি, হত্যা ও জোর জুলুমের স্থান নেই। ধর্ম কখনও মানুষকে অমাননবিক আচরণ শিক্ষা দেয়না। ধর্মের শিক্ষা হলো মানবতা, শান্তি, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সহাবস্থান, জীবে প্রেম, অহিংসা আর সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্যের সন্ধান করা
ধর্ম ও মানুষঃ
যখন প্রথম বাংলা ব্যাকরণ শিখা শুরু করলাম স্যার বললেন, মানুষ জন্ম বা সৃষ্টির পর থেকে ভাষা এসেছে। ভাষা হলো মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম, আর ভাষাকে প্রকাশ করার একটি মাধ্যম হলো বর্ণমালার লিখিত রুপ। ভাষার হাজার বছর পরে বর্ণমালা এবং তারও হাজার হাজার বছর পর ভাষাবিদেরা  ভাষারীতি বা নীতিমালা প্রণয়ন করেন, যেটাকে আমরা ব্যাকরণ বলি। সুতারাং ভাষার জন্য বা ভাষার সহায়ক হলো ব্যাকরণ,  ব্যাকরণের জন্য বা সহায়ক ভাষা নয়। বর্তমানে ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাকরণকে এমন বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে যে, ব্যাকরণ না জানলে ভাষা শিখা যায়না।
এই ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। তবে হা,  ভাষা লিখিত রুপ প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যাকরণ কিছুটা সহায়ক হিসেবে কাজ করে বলতে পারেন। আমরা আমাদের শিশু সন্তানদের ভাষার লিখিত রুপ শিখানো ক্ষেত্রে কি প্রথমে ব্যাকরণ শিখাই ?  উত্তর না। আবার প্রবাসীরা যখন আরব বা ইউরোপে ভাষা শিখে তখন কি ব্যাকরণ শিখে ?  উত্তর না।
তাহলে আমরা বলতে পারি, ভাষার রুপগত আকারকে সুন্দর করার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ সহযোগী ভুমিকা পালন করে মাত্র। পৃথিবীতে এমন শতশত ভাষা আছে,  যেটা ব্যাকরণ তো অনেক দূর, রুপগত আকার বা বর্ণমালা ও নেই। তাহলে আমরা বলতে পারি ভাষার প্রকাশ হলো মৌলিক ও প্রধান বিষয়। আর ব্যাকরণ হলো সহায়ক বিষয় মাত্র। অথচ মানুষ আসলটাকে বাদ দিয়ে নকলটা নিয়ে টানাটানি ও পারাপারি করে মহা ব্যস্ত।
আজকের পৃথিবীতে প্রায় সাতশত কোটির একটু বেশি মানুষ বসবাস করে। যার অর্ধেরও বেশি নারী আর বাকিটা পুরুষ। এই পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির করে পাঠানোর আগে জ্বীন জাতিকে পাঠিয়েছেন। মানুষ পৃথিবীতে আসার আগেও এখানে জ্বীনেরা ছিল। পৃথিবীতে মানুষ ও জ্বিন ছাড়া সব কিছুই মানুষের কল্যাণে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবী কে আল্লাহ মানুষের বসবাসের জন্য এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। কোন বিশেষ শ্রেনী বা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় বা আল্লায় বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী এমন কারো জন্য সৃষ্টি করেননি। কুরআনে বলা হয়েছে,  মানুষের কল্যাণের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। আর ইসলাম হলো আল্লাহর মনোনীত ধর্ম মত বা পথ। ইসলাম ধর্মমত বা পথকে আল্লাহ মানব জাতির জন্য পছন্দ করে দিয়েছেন। তবে মানুষকে দুনিয়াতে  মত বা পথ গ্রহণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন - আমি আল্লাহ যদি চাইতাম, সকল মানুষকে মুসলিম ও ইসলামকে দুনিয়াতে স্থায়ীভাবে কায়েম করতে পারতাম। এটা আমি করিনি কারণ আমি দেখতে চাই, তোমাদের মাঝে কারা আমাকে বিশ্বাস করে ও আমার দেওয়া বিধান মেনে চলে।  তাহলে আমরা বলতে পারি, পৃথিবীর মৌলিক উপাদান হলো মানুষ, সকল মানুষ, এখানে কোন শ্রেনী বা বিশেষ গোষ্ঠির জন্য আল্লাহ পৃথিবী বা অন্য সব কিছু সৃষ্টি বা ইসলাম কে মনোনীত করেননি। মানুষ হলো মৌলিক উপাদান, আর অন্য সব প্রাণী বা জীবজন্তু বা ধর্ম মত বা পথ বা ইসলাম  বা সব সৃষ্টি করেছে শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণে বা প্রয়োজনে। অথচ আজ মানুষকে গৌণ বিষয়  আর ধর্মমত বা পথকে মৌলিক বিষয় বানিয়ে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। যে মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহ পৃথিবীকে সৃষ্টি করলো, ইসলাম ধর্মকে পাঠিয়েছে, এই মানুষ আজ ধর্মের নামে, পৃথিবী শাসনের নামে, পৃথিবীর ক্ষমতার জন্য,  আরেক মানুষকে হত্যা করছে, মানুষ মানুষের উপর জুলুম করছে, নির্যাতন করছে, নিজ ধর্মমত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। মহান আল্লাহ তায়ালা, যিনি সকল জাহানের একমাত্র মালিক ও সৃষ্টিকারী। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করে দুনিয়াতে পাঠালেন এবং যিনি মানুষকে দুনিয়াতে পরীক্ষা করার জন্য স্বাধীন করে দিলেন তার সৃষ্টি মানুষকে আজ মানুষই ক্ষমতার জন্য, ধর্মের নামে, ইসলামের নামে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ধর্মমত বা পথ চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, এটা বিশ্বাস ও স্বেচ্ছায় মানা এবং পালন করার বিষয়। দুনিয়ার জীবনে আমরা যখন স্কুল বা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় বা চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দিই, তখন কি আমরা একজন আরেকজনকে লিখে দিই, বা আমরা কি অন্যের কেমন পরীক্ষা হচ্ছে, সেটা বিষয় নিয়ে ভাবি ?  নাকি নিজের পরীক্ষা নিয়ে ভাবি?
অবশ্যই নিজে পরীক্ষা দেই এবং নিজেকে নিয়ে ভাবি।  কারণ আমার কর্মফল আমাকে ভোগ করতে হবে।  প্রশ্ন নিদিষ্ট আর উত্তর লেখার ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর ফলাফলে প্রশ্নের উত্তর অনুযায়ী পরীক্ষার পর ঘোষণা করা হবে।
দুনিয়াটা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, এখানে প্রত্যেক মানুষ পরীক্ষার্থী আর আল্লাহ সবাইকে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন ক্ষমতা দিয়েছে। আমরা মানুষ হয়ে কাউকে বাধ্য করতে পারিনা। তবে মানুষের কল্যাণময়ী হয়ে সঠিক পথে ডাকতে পারি। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা আল্লাহ কোন নবী বা রাসূলকে ও দেননি। পৃথিবী হলো পরীক্ষার হল, এখানে সবাই সমান সুযোগ পাবে এবং সময়ও সবার জন্য নিদিষ্ট।  এখানে মানুষের নতুন নতুন ভাবনা আছে, চিন্তা আছে, মত বা পথ প্রকাশের ভিন্নতা থাকতে পারে। সবাই পাশ করবেনা, আবার সবাই ফেলও করবেনা বা সমান নাম্বারও পাবেনা। এখানের পরিবেশে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতপার্থক্য মানুষের জন্মগত, আইনগত এবং মুক্তচিন্তা আর স্বাধীন মানসিকতার উর্বর ফসল। যারা মনে করে পৃথিবীর সকল মানুষ একই চিন্তা আর বিশ্বাসের আলোকে চলবে বা পরিচালিত হবে, তাদের চিন্তার গোড়াতে গলদ আছে বলে আমি মনে করি। যারা স্রষ্টাতে বিশ্বাস করে বা ইসলাম ধর্মের অনুসারী, তারা এমনটা কোন ভাবেই বিশ্বাস করার কারন থাকতে পারেনা। আল্লাহ দুনিয়াতে মানুষকে চিন্তা, বিশ্বাস আর মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার পাশাপাশি, নিজের জীবন নিজের মত করে পরিচালিত করারও স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিনি আল্লাহ যদি চাইতেন, তাহলে সবাইকে ইসলামের অনুসারী এবং পৃথিবীতে ইসলামকে একমাত্র পথ ও মত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তা করেননি, তিনি দুনিয়াতে মানুষকে মত ও পথ গ্রহণে স্বাধীনতা দিয়েছে। কাউকে জোর করে বা বাধ্য করে মতামত বা পথ চাপিয়ে দেননি। ধর্ম বা বিশ্বাস মানুষ পৃথিবীতে আসার আগেও ছিল, এখনও আছে। পৃথিবী পূর্ণ আয়ুতে থাকবে। যতদিন থাকবে, ততদিন মতপার্থক্য ও থাকবে।
মতপার্থক্যের জন্য  মানুষ মানুষকে হত্যা করা বা জুলুম করা মানুষের মানবিক গুণ হতে পারেনা। মানুষ সৃষ্টির সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও সম্মানি প্রাণী ।  যারা অন্য সকল প্রাণীর নিয়ন্ত্রক ও পরিচালকের আসনে রয়েছে। মানুষ নিজেকে মহান বা উত্তম দাবি করেন এই যুক্তিতে যে , মানুষ হলো মানবিক ও সহনশীল আচরণকারী অতি বুদ্ধিমান যুক্তিশীল প্রাণী।  মতপার্থক্য বা পথের পার্থক্যের কারণে মানুষের আচরণ অমানুষের মত হতে পারেনা। স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে দুনিয়াতে মত ও পথে স্বাধীনতা দিয়েছে, আর সৃষ্টি চায় সৃষ্টিকে দুনিয়াতে নিয়ন্ত্রক হয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে। এটা কেমন কথা ? মতের প্রচার আপনি করতে পারেন, মানুষকে প্রেম, দয়ার আর আপনার ধর্ম মতের পথে ডাকতে পারেন, আপনার চিন্তার কথাও বলতে পারেন। কিন্তু কাউকে মানতে বা পালন করতে বাধ্য করতে পারেননা, আপনি বাধ্য করার কে?
যে আল্লাহ বাধ্য করার ক্ষমতা রাখেন, তিনিতো বললেন- আমি দুনিয়াতে কাউকে চিন্তা ও পথ গ্রহণে বাধ্য করিনা, এটা দুনিয়া আমি স্রষ্টার উদারতা আর সৃষ্টির পরীক্ষার জায়গা। মানুষ হয়ে স্রষ্টার আইন লঙ্গন করে নিজে স্রষ্টার সৃষ্টিকে হত্যা করা মহা অন্যায় ও অনিয়ম। কর্ম আর কর্মী পৃথিবীতে আপন অধিকার এমন ভাবে ভোগ করবে, যেন অন্যের অধিকারে কোন ধরনের অসুবিধা না হয়। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ মুক্ত মনের মিছিলে স্বাধীন আর আনন্দের সাথে যুক্ত হয়ে শান্তির পথে চলতে হবে। মায়ের বুকে শিশুর নিরাপদ আশ্রয়ের মত করে পৃথিবীকে শান্তি আর সুন্দর নিরাপদ শহর বানাতে হবে। প্রেম, দয়া, সহানুভূতি, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা হবে মানুষের পরম ধর্ম। মানবিকতা আর জীবে ভালোবাসা সবার আগে। অহিংসা মন্ত্রে অহংকার কে জ্বলতে দিতে হবে। মানুষের মিছিলে শ্লোগান হবে- "মুক্তচিন্তায় শান্তির পথ"। এখানে শান্তির জীবন প্রতিষ্ঠা করা সকল ধর্মের বা সকল মত পথের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। এখানে সকল মানুষ রক্ত মাংসে গড়া আল্লাহর সৃষ্টি। সকল সৃষ্টির বেচে থাকা আর জীবনকে ভোগ করার অধিকার রয়েছে।
ইসলাম, মুসলিম ও রিসালাতের শেষ নবীঃ
মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ)  আল্লাহর বান্দা, তাঁর পিতা মোত্তালিব পুত্র আব্দুল্লাহ এবং মাতা আমেনা খাতুন। তিনি জ্বিন বা ফেরেস্তা নয়, তিনি একজন মানুষ। দুনিয়াতে তাঁর আগমন হয়েছে মানুষের সন্তান হিসেবে। মহান আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদ মোস্তফা বা আহমদ মোস্তফা কে দুনিয়াতে আখেরী নবীর হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাঁর মর্যাদা সকল নবীদের উপরে। তিনি সকল সৃষ্টির মাঝে উচ্চ সম্মানের আসনে।  মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) একজন মানুষ, তিনি আল্লাহর নবী, তাঁর মর্যাদা সকল সৃষ্টির উপরে, তিনি আখেরি নবী, তাঁর জন্ম দুনিয়াতে মানুষ হিসেবে হয়েছে, তিনি মানুষের মত করে দুনিয়ার জীবন ত্যাগ করে চলে গেছেন বা মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর আনিত রিসালাত দুনিয়ার জন্য কল্যাণ ও আখেরাতের আল্লাহর আজাব থেকে মুক্তির একমাত্র মাধ্যম।
এই বিশ্বাস গুলো একজন মুমিনের জন্য ঈমানের শর্ত।
আর কুরআন হলো নবী মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) এর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া পবিত্র কিতাব বা গ্রন্থ।  এর বাণী গুলো মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে সকল সৃষ্টির জগতের জন্য আইন হিসেবে পাঠিয়েছেন। কুরআনের আদেশ ও নিষেধ মানা সকল সৃষ্টির জন্য আইন বা ফরজ।
দুনিয়াতে মানুষের জন্য নির্ভুল ও কল্যাণকর একমাত্র গ্রন্থ হলো "কুরআন"। নির্ভুল মানুষ নবী মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) এবং নির্ভুল পথ বা জীবন ব্যবস্থা ইসলাম। যারা উল্লেখ্য বিষয় গুলোর উপর বিশ্বাস করবে ও দুনিয়ার জীবনে মেনে চলবে তাঁরাই মুমিন মুসলিম বা ঈমানদার মুসলিম। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য মনোনীত পথ হলো ইসলাম আর ইসলামের বিধান পালন কারীর একমাত্র পরিচয় হলো মুসলিম এবং মুসলিম। দুনিয়ার জীবন শেষে মৃত্যুর পর আল্লাহর ফেরেস্তারা কবরবাসীকে প্রথমে যে ৩ টি প্রশ্ন করবেন।
তোমার রব কে,
তোমার নবী কে ও
তোমার দ্বীন কি ?
সেদিন সফলকাম লোকদের উত্তর হবে- আমার রব আল্লাহ, আমার নবী আহমদ বা হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) ও আমার দ্বীন হলো "ইসলাম"।
সেদিন যারা এই ৩ টি প্রশ্নের সঠিক জবাব দিবে তারা প্রথমিকভাবে বিজয় লাভ করলো এবং তাদের জন্য শান্তিময় ঘুমের ব্যবস্থা হবে। কবর হবে তাদের জন্য খুবই আরামদায়ক ঘুমের আবাসস্থল। আর যারা সঠিক উত্তর দিতে পারবেনা, তাদের জন্য কবর হবে অতি যন্ত্রণাদায়ক আবাসস্থল।
যারা আল্লাহকে রব, মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) কে রিসালাতের নবী ও ইসলাম কে দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা মনে করেন, তাদের সকলের একমাত্র পরিচয় হলো "মুসলিম"।
এর বাহিরে অন্য পরিচয় থাকতে পারেনা বা হতে পারেনা।
কোন মুসলিম নিজেকে শিয়া, সুন্নী, ওহাবী, খারেজী, হানাফি, হাম্বালী, মালেকী, সাফী, আহালে হাদীসি, মাজহাবী, লা-মাজহাবী, মুতাজিল্লাহ, আহাম্মদী বা অন্য কোন পরিচয়ে দিতে পারবেনা। ইসলামের অনুসারীদের দুনিয়া ও পরকালের একমাত্র পরিচয় হলো মুসলিম এবং মুসলিম। হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) হলো ইসলামী রেসালাতের সর্বশেষ নবী। তাঁর মাধ্যমের ইসলাম দুনিয়াতে পরিপূর্ণতা পেয়েছে।  মানুষসহ সকল সৃষ্টির জীবন বিধান হলো "দ্বীন ইসলাম" আর কুরআন হলো মহান রব আল্লাহ তায়ালা পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য একমাত্র শতভাগ সহী গাইড লাইন গ্রন্থ। এই মহান গ্রন্থ মেনে চলা ইসলামের সকল অনুসারী তথা মুসলমানদের জন্য "ফরজ"। এই কুরআনের মাধ্যমের মুসলমানদের  দুনিয়ার জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত করতে হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ এর অনুসরণের মাধ্যমেই পাওয়া যাবে। নবী মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) উপর আল্লাহ তায়ালা  দীর্ঘ ২৩ বছরে কুরআন নাজিল করেন আর তাঁর ২৩ বছরের নবুয়াত জীবন হলো কুরআনের অনুকরণ ও অনুসরণীয় জীবন। তিনি মুসলমান তথা সকল মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একমাত্র উত্তম বা সর্বোত্তম আদর্শ মানুষ।  তাঁর জীবনের শেষ বেলায় বিদায় হজ্জের সময় আরাফাত ময়দানে ১০ যিলহজ্জ তারিখ কাসওয়া উটনীর পিঠে আসন গ্রহণ করে তিনি একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। সে সময় প্রায় এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার সাহাবী তাঁর চারদিকে সমবেত ছিল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে মানবতার মহান মানব, হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সঃ) বলেন-
হে লোক সকল,  আমার কথা শোনো, আমি জানিনা, এবারের পর আমি তোমাদের সাথে এই জায়গায় আর মিলিত হতে পারবো কিনা। তোমাদের রক্ত ও ধন-সম্পদ পরস্পরের জন্য আজকের দিন, বর্তমান মাস এবং এই শহরের মতই নিষিদ্ধ। শোনো মানুষ সকল, জাহেলিয়াত যুগের সবকিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের খুনও খতম করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে রক্ত আমি শেষ করেছি তা হচ্ছে, রবিয়া ইবনে হারেসের পুত্রের রক্ত। জাহেলী যুগের সুদ খতম করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে সুদ আমি খতম করেছি তা হলো, আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেবের সুদ, এখন থেকে সুদ শেষ করে দেওয়া হলো। আর নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, তোমারা তাদের আল্লাহর আমানতের সাথে গ্রহণ করেছো, আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে হালাল করেছো। তাদের উপর তোমাদের অধিকার,  তারা তোমাদের বিচানায় এমন কাউকে আসতে দিবেনা যাদের তোমরা পছন্দ করোনা। তোমাদের উপর তাদের অধিকার, তোমরা তাদের ভালো পানাহার ও পোশাক দিবে। তোমাদের কাছে আমি এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা ধারণ করে থাকো তবে কখনও পথভ্রষ্ট হবেনা "তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব"।
মনে রেখো আমার পর কোন নবী নেই, তোমাদের পর কোন উম্মত নেই। আল্লাহর ইবাদত করবে, নামায আদায় করবে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, আনন্দের সাথে নিজ সম্পদের যাকাত দিবে, আল্লাহর ঘরে হজ্জ করবে, নিজ শাসকদের আনুগত্য করবে, যদি এরুপ করো, তবে আল্লাহর জান্নাতে প্রবেশ করবে। তোমাদেরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা কি বলবে ?
লক্ষ সাহাবী সমস্বরে বললেন, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি,  আপনি তাবলীগ করেছেন, পয়গাম পৌছে দিয়েছেন, কল্যাণ কামনার হক আদায় করেছেন। এ কথা শুনে বিশ্ব নবী মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) নিজের শাহাদাত আঙুল আকাশের দিকে তুলে লোকদের দিকে ঝুঁকে তিনবার বলেন, হে আমার রব, তুমি সাক্ষী থেকে।
তাঁর কথাগুলো হযরত রবিয়া ইবনে উমাইয়া ইবনে খালাফ উচ্চকণ্ঠে উপস্থিত সবার কাছে পৌছে দিচ্ছিলেন।  আর আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর সেদিনের সাথীরা অঝোরে কান্না করছিলো। হযরত ওমর (রাঃ) কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, পূর্ণাঙ্গতার পরতো অপূর্ণাঙ্গতাই থেকে যায়। ভাষণ শেষ করার পর আল্লাহ তায়ালা কুরআনের আয়াত নাযিল করেন- "আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাংগ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পর্ণ করলাম, ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম"।
(সুরা মায়েদা, আয়াত-০৩)
পরিশেষে বলবো, দুনিয়ার জন্ম-মৃত্যু স্রষ্টার সৃষ্টি, সময়ের শুরু ও শেষ এবং রুহ বা আত্মা এসব স্রষ্টার চিরন্তন সত্য ও একান্ত অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। জন্ম ও
মৃত্যু এমনই এক চিরসত্য বিধান
যেমন সত্য এই পৃথিবীতে আমার জন্ম,
আমার উপস্থিতি ও পদচিহ্ন। জন্মকে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার যেমন ছিলোনা, ঠিক তেমনি মৃত্যু থেকে মুক্তির কোন ক্ষমতা বা পথ এই জীবনের নেই। প্রতিটি জীবনের চিরন্তন পতনের সঙ্গী মৃত্যু। আমার আগমনের চিরসাথী আমার চিরবন্ধু মৃত্যু।  হে আমার জন্মের নিয়ন্ত্রণকারী মহান স্রষ্টা, হে আমার আত্মার প্রশান্তিদানকারী মহান প্রভু, হে সকাল জাহানের একমাত্র মালিক ও খালিক, হে আমার মৃত্যু দানকারী,
হে আমার  পরিকল্পনা ও পরিচালনাকারী,
আমি তোমার থেকে আগত ও তোমার দিকে প্রত্যাগত, তোমারই ইচ্ছার অধীন।
আমার অন্তরকে তোমার স্বরূপের ভালোবাসায় প্রশান্তি দান করো।
(আমীন)
লেখকঃ
মুহাম্মাদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স), এমএসএস(অর্থনীতি)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Wednesday, September 25, 2019

আজ কবি ও লেখক "মহসীন ভূঁইয়া"র ৩৯তম জন্মদিন

আজ কবি ও লেখক "মহসীন ভূঁইয়া"র ৩৯তম জন্মদিন

তরুন কবি ও লেখক, বাংলাদেশ লেবার পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং যুক্তফ্রন্টের শীর্ষনেতা মহসীন ভূঁইয়ার ৩৯তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯৮০ সালের ২৫ই সেপ্টেম্বর কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার রায়কোট উত্তর ইউনিয়নের দক্ষিণ মাহিনী ভূঁইয়া বাড়ির জনাব, আলহাজ্ব আব্দুল খালেক ভূঁইয়া ও জনাবা, মনোয়ারা বেগম এর পরিবারে জন্ম হয় এই তরুন কবি'র। কবি মহসীন ভূঁইয়া, মাহিনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করে মন্তলী রহমানিয়া ফাযিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পড়াশোনা শেষ করেন এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয় অনার্স ও মাস্টার্স করেন। তিনি বর্তমানে "আব্দুস সাত্তার ডিগ্রী কলেজ" এ অর্থনীতি অনার্স বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি কবি মহসীন ভূঁইয়া রাজনীতি ও গবেষণা মূলক লেখালেখি করেন। জন্মদিনে তরুন কবি ও লেখক মহসীন ভূঁইয়াকে জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
২৫/০৯/২০১৯
(বিশ্ব কবিতালয় পরিষদ)

Wednesday, August 21, 2019

মহসীন ভূঁইয়া "নাগরিক অধিকার" এর নির্বাহী পরিচালক

মহসীন ভূঁইয়া "নাগরিক অধিকার" এর নির্বাহী পরিচালকঃ

বিশিষ্ট কবি,লেখক,গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী  মহসীন ভূঁইয়া "নাগরিক অধিকার " এর নির্বাহী পরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার দক্ষিন মাহিনী ভূঁইয়া বাড়ির আলহাজ্ব আব্দুল খালেক ভূঁইয়ার ৫ম সন্তান। জনাব ভূঁইয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয় পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে অধ্যাপনার পাশাপাশি গবেষণার ধর্মীয়  লেখালেখি ও রাজনীতির সাথে জড়িত আছেন। তিনি বাংলাদেশ লেবার পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও  যুক্তফ্রন্টের শীর্ষনেতা। বাংলাদেশের সামাজিক ও মানবিক অধিকার বিষয় গণসচেতনতা সৃষ্টির  লক্ষ্যে (সিটিজেন রাইট) নাগরিক অধিকার  গত একযুগ ধরে আসছে।

প্রেসবিজ্ঞপ্তি
২১/০৮/২০১৯

Friday, August 2, 2019

ইসলাম কি ? মুহাম্মাদ মহসীন ভূঁইয়া

মৃত্যুর পর আল্লাহর ফেরেস্তারা কবরবাসীকে প্রথমে যে ৩ টি প্রশ্ন করবেন।
তোমার রব কে, তোমার নবী কে ও তোমার দ্বীন কি ?
সেদিন সফলকাম লোকদের উত্তর হবে- আমার রব আল্লাহ, আমার নবী আহমদ বা হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) ও আমার দ্বীন হলো "ইসলাম"।
সেদিন যারা এই ৩ টি প্রশ্নের সঠিক জবাব দিবে তারা প্রথমিকভাবে বিজয় লাভ করলো এবং তাদের জন্য শান্তিময় ঘুমের ব্যবস্থা হবে। কবর হবে তাদের জন্য খুবই আরামদায়ক ঘুমের আবাসস্থল। আর যারা সঠিক উত্তর দিতে পারবেনা, তাদের জন্য কবর হবে অতি যন্ত্রণাদায়ক আবাসস্থল।

যারা আল্লাহকে রব, মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) কে রিসালাতের নবী ও ইসলাম কে দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা মনে করেন, তাদের সকলের একমাত্র পরিচয় হলো "মুসলিম"।
এর বাহিরে অন্য পরিচয় থাকতে পারেনা বা হতে পারেনা।
কোন মুসলিম নিজেকে শিয়া, সুন্নী, ওহাবী, খারেজী, হানাফি, হাম্বালী, মালেকী, সাফী, আহালে হাদীসি, মাজহাবী, লা-মাজহাবী, মুতাজিল্লাহ, আহাম্মদী বা অন্য কোন পরিচয়ে দিতে পারবেনা। ইসলামের অনুসারীদের দুনিয়া ও পরকালের একমাত্র পরিচয় হলো মুসলিম এবং মুসলিম। হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) হলো ইসলামী রেসালাতের সর্বশেষ নবী। তাঁর মাধ্যমের ইসলাম দুনিয়াতে পরিপূর্ণতা পেয়েছে।  মানুষসহ সকল সৃষ্টির জীবন বিধান হলো "দ্বীন ইসলাম" আর কুরআন হলো মহান রব আল্লাহ তায়ালা পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য একমাত্র শতভাগ সহী গাইড লাইন গ্রন্থ। এই মহান গ্রন্থ মেনে চলা ইসলামের সকল অনুসারী তথা মুসলমানদের জন্য "ফরজ"। এই কুরআনের মাধ্যমের মুসলমানদের  দুনিয়ার জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত করতে হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ এর অনুসরণের মাধ্যমেই পাওয়া যাবে। নবী মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) উপর আল্লাহ তায়ালা  দীর্ঘ ২৩ বছরে কুরআন নাজিল করেন আর তাঁর ২৩ বছরের নবুয়াত জীবন হলো কুরআনের অনুকরণ ও অনুসরণীয় জীবন। তিনি মুসলমান তথা সকল মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একমাত্র উত্তম বা সর্বোত্তম আদর্শ মানুষ।

Sunday, July 21, 2019

সাবধান ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা বেঈমানঃ মুহাম্মাদ মহসীন ভূঁইয়া

সাবধান
ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা  বেঈমানঃ

(মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া)

আরাকানে বসবাস কারী  কিছু সংখ্যক মুসলিম ও হিন্দু স্থায়ী অধিবাসীদের রোহিঙ্গা বলা হয়ে থাকে, রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের পূর্বে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারি হলেও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারিও রয়েছে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে বার্মার জান্তা সরকার একটি ঘোষণার মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেন। আমার লেখায় এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক পরিচয় ও বাংলাদেশ তথা ভারত বর্ষের সাথে তাদের সম্পর্কের কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

বর্তমানে রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবস্থানের প্রাথমিক চিত্র হলো- (১৫০০০০০–২০০০০০০) লক্ষ রোহিঙ্গা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চলসমূহ মধ্যে মায়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, সৌদি আরব।

মায়ানমার (১০০০০০)
বাংলাদেশ (১১০০,০০০)
পাকিস্তান (২০০,০০০)
থাইল্যান্ড (১০০,০০০)
মালয়েশিয়া (৪০,০৭০)
ভারত (৪০,০০০)
যুক্তরাষ্ট্র (১২,০০০)
ইন্দোনেশিয়া (১১,৯৪১)
সৌদিআরব (৩ থেকে ৫ লক্ষ)
নেপাল (২০০)

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ সালের আইন করে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে মায়ানমার জান্তা সরকার। ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহি

ঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। এছাড়াও তাদের রাজনীতি, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো দমন ও নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূলতা হিসেবে অাখ্যা দিয়েছে।

এবং যেখানে গণহত্যার মত অপরাধের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যেতে পারে মতপ্রকাশ করেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত মায়ানমারের বিশেষ তদন্তকারী ইয়ং হি লি-বিশ্বাস করেন, মায়ানমার পুরোপুরি তাদের দেশ থেকে রোহিঙ্গা জাতি গোষ্ঠীকে বিতড়িত করতে চায়।

২০০৮ সালের সংবিধান অনুসারে, মায়ানমারের সেনাবাহিনী এখনো সরকারের অধিকাংশ বিষয় নিয়ন্ত্রন করে থাকে যার মধ্যে অন্তুর্ভূক্ত রয়েছে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেনাবাহিনীর জন্য সংসদে ২৫% আসন বরাদ্দ রয়েছে এবং তাদের জন্য উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সংরক্ষিত থাকবেন।

মায়ানমার সরকারের এই অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী আচরণের পর থেকে রোহিঙ্গারা বার বার বলে আসছে, তারা পশ্চিম মায়ানমারে অনেক আগে থেকে বসবাস করে আসছেন। তাদের বংশধররা প্রাক-উপনিবেশিক ও উপনিবেশিক আমল থেকে আরাকানের বাসিন্দা ছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে নির্যাতন শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রোহিঙ্গারা আইনপ্রণেতা ও সংসদ সদস্য হিসেবে মায়ানমারের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পূর্বে যদিও মায়ানমার রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করত কিন্তু হঠাৎ করে মায়ানমার সরকারের মনোভাব বদলে যায় এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মায়ানমার সরকারের অফিসিয়াল মন্তব্য হলো তারা মায়ানমার জাতীয় জনগোষ্ঠী নয় বরং তারা বাংলাদেশ  থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। মায়ানমারের সরকার তখন থেকে “রোহিঙ্গা” শব্দটি ব্যবহার বন্ধ করে তাদের বাঙ্গালী বলে সম্বোধন করে আসছে। রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আরাকান রোহিঙ্গা জাতীয় সংস্থা বহুদিন থেকে তাদেরকে মায়ানমারের মধ্যে জাতিসত্ত্বার পরিচয় দেওয়ার দাবী করে আসছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংগঠন "জাতিসংঘ" তাদের তদন্তের প্রতিবেদনে বলেন, রোহিঙ্গারা মায়ানমারের ভিতরে অতি-জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের দ্বারা ঘৃণা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার শিকার হচ্ছে। একই সাথে মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত গণহত্যা, অবৈধ গ্রেফতার, নির্যাতন, ধর্ষণ, গুমখুন এবং অপব্যবহারের শিকার হওয়ার পাশাপাশি তাদের জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করছেন। জাতিসংঘের মতানুসারে, রোহিঙ্গাদের উপর চলা এ নির্যাতনকে মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে বলা যেতে পারে।

২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালের সেনাবাহিনীর অভিযানের পূর্বে মায়ানমারে ১.১ থেকে ১.৩ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাস করতেন। যাদের অধিকাংশের বাসস্থান ছিল মুলত ৮০-৯৮% রোহিঙ্গা অধ্যূষিত রাখাইন রাজ্যে। ১০০০,০০০ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে দক্ষিণ-পূর্বের পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিবেশী দেশসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ১০০,০০০-এর বেশি রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচুত হয়ে মায়ানমারের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে রয়েছে। ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় ১২ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলে মায়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরোদ্ধে “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” শুরু করে। এই অপারেশনে প্রায় (২০০০০) বিশ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হন, অনেক রোহিঙ্গা আহত, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন। তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ১০-১২ লক্ষ এর বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

রোহিঙ্গাদের প্রকৃত সংখ্যা কত হবে
তা নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিস্তর ফারাক জাতিসংঘ ও অন্যান্যদের। ইউএনএইচসিআরের মতে বাংলাদেশে ৫ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও এনজিও প্রতিনিধিরা বলছেন, নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। তাদের যুক্তি হলো, ইউএনএইচসিআর তাঁবু ধরে যে প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গার সংখ্যা নির্ধারণ করছে, বাস্তবতা তার  ভিন্ন।

রোহিঙ্গাদের একটি অংশ তাঁবুর বাইরে অবস্থান করছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন স্থানে গভীর অরণ্যেও নিজেদের মতো করে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। সেখানে কোনো জরিপ চালানো হয়নি।
এ ছাড়া একটি অংশ কক্সবাজারে আত্মীয়স্বজনদের বাসায়ও উঠেছে। এগুলোও গণনার বাইরে।
বর্তমানে প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হলেও বাস্তবে এর চেয়ে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এই বিশাল সংখ্যক অভিবাসী ঐ জনপদে এদেশের নাগরিকদের সাথে সহাবস্থানের আছে।

মায়ানমার সরকার ও বৌদ্ধ চরমপন্থীদের দ্বারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময় নির্যাতনের ও গণহত্যার শিকার হয়েছে। এবার এর কিছু চিত্রের তথ্য দিবো।

ধর্মীয় ও জাতিগত নিধনের উদ্দেশ্যে
২০১৬-১৭ মায়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বা নিপীড়ন হয়েছে ব্যাপক হারে, মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশের দ্বারা দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমান ও হিন্দু জনগোষ্ঠির উপর চালানো হয় সামরিক অভিযান।  এটি ২০১২ সালের অক্টোবরে অজ্ঞাত বিদ্রোহীর দ্বারা বার্মা সীমান্তে হামলার একটি প্রতিক্রিয়া ছিল। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও শিশুহত্যাসহ অত্যধিক  মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত  মায়ানমার কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত হয়েছে।

মায়ানমারে অজ্ঞাত বিদ্রোহীর দ্বারা বার্মা সীমান্ত পুলিশ পোস্টে হামলা অভিযোগ করে রোহিঙ্গাদের সাথে বহুদিন ধরে খারাপ আচরণ বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বিদ্যমান অংশগ্রহণকারী সামরিক শাসকদের হাতে বিস্তৃতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়, এবং গণহারে বাস্তুচ্যুত বলপূর্বক স্থানান্তর ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ গণহত্যার মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়।

রোহিঙ্গা জনগণের ওপর এই সামরিক অভিযান জাতিসংঘ (যা "মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ" হিসেবে চিহ্নিত), মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট, প্রতিবেশী বাংলাদেশ সরকার এবং মালয়েশিয়ার সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দা জানান। ( যেখানে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে গেছে)। মায়ানমার সরকার প্রধান, অং সান সু চি, বিশেষ করে তার নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতার জন্য এবং এই সামরিক অপব্যবহার প্রতিরোধে বলতে গেলে কোন কাজ না করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন।

রোহিঙ্গা জনগণদেরকে "পৃথিবীতে সবচেয়ে কম প্রয়োজন বোধ করা"এবং "সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের মধ্যে অন্যতম" বর্ণনা করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের মুক্তভাবে চলাফেরা এবং উচ্চশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।বার্মিজ জাতীয়তা আইন প্রণীত হওয়ার পর থেকে তাদের বার্মিজ নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তারা কোনও সরকারী অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারবে না এবং পূর্বে তাদের দুই সন্তানের বেশি না নেয়ার প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করতে হত, যদিও এই আইনটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। তারা রুটিনমাফিক জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিগৃহীত; সাধারণতঃ রোহিঙ্গা পুরুষদের সপ্তাহে এক দিন সামরিক ও সরকারি প্রকল্পে কাজ করতে হবে এবং এক রাতের জন্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে হবে। রোহিঙ্গারা মায়ানমারের অন্যত্র থেকে বৌদ্ধ বাসিন্দাদেরকে দেয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে আবাদি জমি হারিয়েছে।

এবার আমি আপনাদের বুঝার জন্য মায়ানমার রাষ্ট্রের ভৌগোলিক ও নাগরিক অবস্থানের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরছি,

মায়ানমার বার্মা নামেও পরিচিত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ, যার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশ ও ভারত এবং পূর্বদিকে চীন, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমানা দ্বারা পরিবেষ্টিত। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সম্প্রতি মায়ানমারে উত্থাপিত গণতন্ত্র, ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর, স্বাধীন নির্বাচন করার অনুমতি দেয়, যা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীঅং সান সু চিকে গৃহবন্দী থাকার পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে ।

মায়ানমার মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী (জনসংখ্যার ৮৮% -৯০%), ভিন্ন বিশ্বাসী কিছু সংখ্যালঘুসহ, সংখ্যালঘুদের মধ্যে মুসলমান ৪%, যাদের বেশিরভাগকেই ভোট দিতে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে (কামান জাতি ব্যতীত)। মায়ানমার তার সংখ্যাগরিষ্ঠ বমা জাতি (বা বর্মণ) (৬৮%) দ্বারা প্রভাবিত, যাদের অধিকাংশই বৌদ্ধ।

বেশ কয়েকটি জাতিগত গোষ্ঠী সরকার কর্তৃক বৈষম্য, অপব্যবহার এবং অবহেলার শিকার; পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের উপকূল, এটি মূলত বৌদ্ধ রাখাইন (৪%, প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ) এবং মুসলিম রোহিঙ্গা (২%, প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ) অধ্যুষিত, যারা সরকারের হাতে নিপীড়নের শিকার। জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধরা প্রায়ই রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্য করে, বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ও সহিংসতা সৃষ্টি করেছে।রোহিঙ্গারা তাদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি সহকারে একটি স্বতন্ত্র জাতি, তবে তারা রাখাইন রাজ্যের সাথে দীর্ঘ ঐতিহাসিক সম্পর্কের দাবিদার।

রোহিঙ্গারা নিজেদেরকে আরব ব্যবসায়ীদের বংশধর হিসেবে বর্ণনা করে, যারা বহু প্রজন্ম আগে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল।ইতিহাসের পণ্ডিতরা বলেন যে, তারা ১৫ শতাব্দী থেকে এই অঞ্চলে অবস্থান করছে।তবে, মায়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছে এবং তাদেরকে বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বর্ণনা করেছে।

বর্তমান সময়কার, মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর অত্যাচার ১৯৭০-এর দশক থেকে চলে আসছে। তখন থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়মিতভাবে সরকার ও জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের দ্বারা নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।মায়ানমারের অতীতের সামরিক শাসকদের দ্বারা প্রায়ই বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী শোষিত হয়েছে যা তাদের মাঝে চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা তৎকালীন সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে আসছে। এর ফলে অনেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে।২০০৫ সালে, জাতিসংঘের শরণার্থীদের জন্য হাই কমিশনার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সহায়তা দিয়েছিলেন, কিন্তু শরণার্থী শিবিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এই প্রচেষ্টাকে হুমকিতে ফেলেছে। ২০১৫-তে, ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ১,৪০,০০০ রোহিঙ্গা আইডিপি ক্যাম্পে অবস্থান করে।

অতি সাম্প্রতিক সহিংসতার আগে, ১৭ মার্চ ২০১৬-তে “এট্রোসিটিজ প্রিভেনশন রিপোর্টে”, মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি-

"রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যেদীর্ঘমেয়াদী ঐতিহাসিক উত্তেজনা সংমিশ্রন, সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাত, আর্থ-সামাজিক অবনয়ন এবং বার্মার সরকার দ্বারা রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয়েই দীর্ঘস্থায়ী প্রান্তিককরণ, রাখাইন রাজ্যের অবস্থা গুরুতর করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দারিদ্র্যতার হার সর্বোচ্চ (৭৮ শতাংশ) এবং দেশটির সবথেকে দরিদ্র রাজ্য। একদিকে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা বিনিয়োগের অভাবের ফলে জীর্ণশীর্ণ অবকাঠামো এবং নিকৃষ্ট সামাজিক সেবায় পরিণত করেছে, অপরদিকে আইনশৃঙ্খলার অযোগ্যতাগুলি নিরাপত্তাহীনতার দিকে ধাবিত করছে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিশেষ করে বার্মার সরকারের নির্যাতন, বেআইনী গ্রেপ্তার ও আটক, চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা, ধর্মীয় অনুশীলনের ওপর ততা ধর্ম পালনে নিষেধাজ্ঞা, কর্মসংস্থান এবং বৈষম্যমূলক সামাজিক সেবা সহ সহিংসতার মুখোমুখি হয়। ২০১২ সালে, অন্তর্বর্তীকালীন দ্বন্দ্বের ফলে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা মারা যায় এবং ১,৪০,০০০ জন লোক বাস্তুচ্যুত হয়। ২০১৩-২০১৫ জুড়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে"

এখন আমি পাঠকদের যেন বুঝতে সহজ হয়, তাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক আগমন ও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকের সাথে মিশে যাওয়া এবং নিজ দেশ মায়ানমার এর সাথে বেঈমানীর কিছু তথ্য ও তাদের ইতিহাসের  ধারাবাহিকতার চিত্র তুলে ধরছি-
১৫৫৪ সালের আরাকানের মুদ্রা যা বৃহত্তর বাংলায় ব্যবহৃত হত।
অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলিমদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিকট  মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।

ম্রক-ইউ রাজ্যের সম্রাট নারামেখলার (১৪৩০-১৪৩৪) শাসনকালে বাঙালিদের আরাকানে বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত থাকার পরে সম্রাট বাংলার সুলতানের সামরিক সহায়তায় পুনরায় আরাকানের সিংহাসনে আরোহন করতে সক্ষম হন। যে সব বাঙালি সম্রাটের সাথে এসেছিল তারা আরাকানে বসবাস করতে শুরু করে। সম্রাট নারামেখলা বাংলার সুলতানের দেওয়া কিছু অঞ্চল ও আরাকানের ওপর সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন। সম্রাট নারামেখলা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বাংলার প্রতি কৃ্তজ্ঞতা স্বরূপ আরাকানে বাংলার ইসলামি স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন। পরবর্তীতে নারামেখলা নতুন মুদ্রা চালু করেন যার একপাশে ছিল বর্মি বর্ণ এবং অপরপাশে ছিল ফার্সি বর্ণ। বাংলার প্রতি আরাকানের কৃ্তজ্ঞতা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। ১৪৩৩ সালে সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহের মৃত্যু হলে সম্রাট নারামেখলার উত্তরাধিকারীরা ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেন। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। বাংলার সুলতানদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও আরাকানের রাজাগণ মুসলিম রীতিনীতি বজায় রেখে চলেন। বৌদ্ধ রাজাগণ নিজেদেরকে বাংলার সুলতানদের সাথে তুলনা করতেন এবং মুঘলদের মতোই জীবন যাপন করতেন। তাঁরা মুসলিমদেরকেও রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতেন। ১৭ শতকের দিকে আরাকানে বাঙালি মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা আরাকানের বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে কাজ করতো। যেহেতু রাজাগণ বৌদ্ধ হওয়ার পরেও বাংলার সুলতানদের রীতিনীতি অনুযায়ীই রাজ্য পরিচালনা করতো, তাই আরাকানের রাজদরবারে বাংলা, ফার্সি এবং আরবি ভাষার হস্তলিপিকরদের মধ্যে অনেকেই ছিল বাঙালি। কামেইন বা কামান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যারা মিয়ানমার সরকারের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্ত্বার মর্যাদা পেয়েছে তারা আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠীরই একটা অংশ ছিল।

১৭৮৫ সালে বর্মিরা আরাকান দখল করে। এর পরে ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বর্মিদের গ্রেপ্তার এড়াতে এবং আশ্রয়ের নিমিত্তে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। বার্মার শাসকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে তখন যেন এটি ছিল একটি মৃত্যুপুরী। ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত "বার্মা সাম্রাজ্য"তে ব্রিটিশ ফ্রাঞ্চিজ বুচানন-হ্যামিল্টন উল্লেখ করেন, "মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) - এর অনুসারীরা", যারা অনেকদিন ধরে আরাকানে বাস করছে, তাদেরকে "রুইঙ্গা" (Rooinga) জাতি কখনোই নিজেদেরকে "আরাকানের স্থানীয় বাসিন্দা" বা "আরাকানের মূলনিবাসী" (Native of Arakan) উল্লেখ করে নি।

ইংরেজ শাসন আমলে কৃষিকাজের জন্য আরাকানের কম জন-অধ্যুষিত এবং উর্বর উপত্যকায় আশপাশের এলাকা থেকে বাঙালি অধিবাসীদের অভিবাসন করার নীতি গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। আরাকান ও বাংলার মাঝে কোন আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছিল না এবং এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোন বিধিনিষেধও ছিল না। তাছাড়া ব্রিটিশরা আরাকান দখলের পূর্বেকার সময় কালাদান নদীর উত্তর তীর পর্যন্ত চট্টগ্রামের দক্ষিণ সীমানা ছিল, যা বার্মার সাথে যুক্ত ছিল বলে কোন ঐতিহাসিক দলিলের অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয় নি। উনবিংশ শতকে হাজার হাজার বাঙালি কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানে গিয়ে বসতি গড়েছিল। এছাড়াও হাজার হাজার রাখাইন আরাকান থেকে বাংলায় চলে এসেছিল।

১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের করা এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, আরাকানে তখন ৫৮,২৫৫ জন মুসলিম ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৮,৬৪৭ জন হয়। অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বাংলার সস্তা শ্রম যা আরাকানের ধান ক্ষেতের কাজে লাগত। বাংলার এই অধিবাসীরা (বেশিরভাগই ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলের) মূলত আরাকানের দক্ষিণেই অভিবাসিত হয়েছিল। এটা নিশ্চিত যে, ভারতের এই অভিবাসন প্রক্রিয়া ছিল পুরো অঞ্চল জুড়ে, শুধু আরাকানেই নয়। ঐতিহাসিক থান্ট মিন্ট-ইউ লিখেছেন: "বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বার্মায় আসা ভারতীয়দের সংখ্যা কোনভাবেই আড়াই লক্ষের কম নয়। এই সংখ্যা ১৯২৭ সাল পর্যন্ত বাড়তেই থাকে এবং অভিবাসীদের সংখ্যা হয় ৪৮০,০০০ জন, রেঙ্গুননিউ ইয়র্ককেও অতিক্রম করে বিশ্বের বড় অভিবাসন বন্দর হিসেবে। মোট অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.৩ কোটি (১৩ মিলিয়ন)।" তখন বার্মার রেঙ্গুন, আকিয়াব, বেসিন, প্যাথিন এবং মৌমেইনের মত অধিকাংশ বড় শহরগুলোতে ভারতীয় অভিবাসীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশ শাসনে বর্মিরা অসহায়ত্ব বোধ করত এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে তারা অভিবাসীদের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত।

অভিবাসনের ফলে সংঘাত মূলত আরাকানেই ছিল সবচেয়ে প্রকট। ১৯৩৯ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার অবসানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন জেমস ইস্টার এবং তিন তুতের দ্বারা একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে। কমিশন অনুসন্ধান শেষে সীমান্ত বন্ধ করার সুপারিশ করে। এর মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরে ব্রিটিশরা আরাকান ছেড়ে চলে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ বার্মা আক্রমণ করে। ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ব্রিটিশপন্থীদের সাথে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়। জাপানিদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্থী অস্ত্রধারী মুসলিমদের দল বাফার জোন সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গারা যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল এবং জাপানি শক্তির বিরোধিতা করেছিল, পর্যবেক্ষণে সাহায্য করেছিল মিত্রশক্তিকে।

জাপানিরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। এই সময়ে প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে গিয়েছিল।

জাপানি এবং বর্মিদের দ্বারা বারংবার গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসে।

পরে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির সময় রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহের সাথে একাধিক বৈঠক করে পাকিস্তানের সাথে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। তাদের এই কাজটা আরাকানের অন্য জাতিগোষ্ঠিরা মেনে নিতে পারেননি। তাদের কপালে “বেঈমান” তকমা লেগে যায়। এদিকে জিন্নাহ রোহিঙ্গাদের প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানান। তখন তারা নিজেরাই রোহিঙ্গা মুসলিম পার্টি গঠন করে আরাকান স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার বার্মায় ক্ষমতা পেলে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ১৯৭৮ আর ১৯৯২ সালে দুইবার তাদের উপর সামরিক অভিযান চালানো হলে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে বার্মা শাসন করছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। আর এর ফলেই তারা রোহিঙ্গা, চীনা জনগোষ্ঠী যেমন - কোকাং, পানথাইদের(চীনা হুই মুসলিম) মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে ব্যপকভাবে নির্যাতন করে থাকে। কিছু নব্য গণতন্ত্রপন্থী নেতা যারা বার্মার প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে এসেছেন তারাও রোহিঙ্গাদের বার্মার জনগণ হিসেবে স্বীকার করেন না।

বার্মার সরকার রোহিঙ্গা ও চীনা জনগোষ্ঠীর মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার উসকানি দিয়ে থাকে এবং এ কাজ তারা অতি সফলতার সাথেই করে যাচ্ছে।

এছাড়াও রাখাইনে ২০১২ সালের দাঙ্গা হচ্ছে মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম ও বোদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের ঘটনাপ্রবাহ। দাঙ্গা শুরু হয় জাতিগত কোন্দলকে কেন্দ্র করে এবং উভয় পক্ষই এতে জড়িত হয়ে পরে। আর এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে।

বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি তথ্য মতে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা নাগরিক অবস্থা করছে। যার বেশিরভাগ নারী ও শিশু রয়েছে, আর নারীদের অধিকাংশই মায়নমারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে এদেশে এসেছে। প্রায় ২০ হাজার শিশু পিতা-মাতাহীন এতিম এবং বেসরকারি তথ্য মতে গত ২ বছরে আরো ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিশাল একটা অংশ শারীরিক এবং মানসিকভাবে  অসুস্থ।  এই বিশাল জনসংখ্যার অবস্থান একটি নিদিষ্ট এলাকায় স্থানীয়দের সাথে হওয়াতে সামাজিক, প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক ভাবে ঐ এলাকাটিতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গারা অধিকাংশ অশিক্ষিত, অসচেতন ও অভাবগ্রস্থ হওয়াতে তাদের নিজেদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, হানাহানি, মাদক চোরাচালান ও নারী পাচার এবং দেহব্যবসার মত কাজ দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রার্থকের কারনে কিছু কিছু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।  রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা বাহিরে অবাদে চলাচল করছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।  এরমধ্যে অনেক বার রোহিঙ্গা ও স্থানীয় নাগরিকদের মাঝে সংঘর্ষের ঘঠনাও ঘঠেছে।  ক্যাম্প এলাকায় স্থানীয় নাগরিকদের তুলনার রোহিঙ্গার সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় স্থানীয়রা এখন রোহিঙ্গাদের কাছে অনেকটা জিম্মি হওয়ার মত। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের দিয়ে কিছু দেশি ও বিদেশি মহল উস্কানিমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া চেষ্টা করছে। ঐ এলাকাটি আন্তর্জাতিক ও দেশিয় মাদক চোরাচালানের লিংক রোড হওয়াতে রোহিঙ্গাদের একটা অংশ ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। অতিবৃষ্টি প্রবণ ও সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা হওয়ার কারণে বর্ষায় মৌসুমে ঐ এলাকাটিতে ব্যাপক মানবিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। পাহাড়ি বনভূমি হওয়ায় গরমেও ব্যাপক হারে বিশুদ্ধ পানির সংকট এবং ডায়রিয়া সহ নানান রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও এইচআইভি আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ব্যাপক, এবং এর সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।  ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অসচেতনতার কারণে এদের জন্মনিরোধক ঔষধ ব্যবহার করার হার একেবারেই কম, যার ফলস্বরূপ গত দুই বছরে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। মোট কথায় বলতে গেলে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এলাকা রোহিঙ্গা অভিবাসীদের চাপে মানবিক বিপর্যয় চরম আকার নিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই আইন শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে।  স্থানীয় নাগরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে রোহিঙ্গাদের সংঘাত ও সংঘর্ষ একটি নিয়মিত ঘটনা। আবার রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হয়েছে, এরা বিভিন্ন নামে বেনামে গ্রুপিং করছে।বর্তমানে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও মানব পাচারের মত অপরাধ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিশেষে বলবো, আরাকানের ভূমি ইতিহাসের সাথে রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং ঐ ভূমিটির নাগরিক দাবিদার হওয়ার জন্য রোহিঙ্গারা অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা (মায়ানমার নাগরিক) আশ্রয় দিয়ে পৃথিবীতে এক বিরল মানবিকতার ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যদিও একটি উন্নয়নশীল অধিক জনসংখ্যার দেশে হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটা একটা ঝুকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিলো। তারপরও এই আশ্রয় বাঙালির মানবিকতার ইতিহাসকে বিশ্বের বুকে নজিরবিহীন সম্মানের আসনে নিয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা  কয়েকশত বছর ধরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গিয়ে আরাকানে
বসবাস করে আসছে।  গত কয়েক দশকে ধরে তাদের উপর মায়ানমার সরকার ও উগ্র বৌদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠির নির্যাতন  চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং বাংলাদেশ ও মায়ানমার সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে। এই সমস্যাকে আন্তর্জাতিক মহল ও মায়ানমার সরকার গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে এবং যতদ্রুত সময়ে সম্ভব এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নাগরিক ও মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে আরাকানে তাদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করে মায়ানমার ফিরিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে এই মানবিক ও জাতিগত সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরে তাদের ফিরিয়ে নিতে মায়ানমার সরকারকে বাধ্য  করা এবং এই মহূর্তে রোহিঙ্গা নাগরিকদেরকে আমাদের মূল ভূখণ্ডের বাহিরে আলাদা একটি নিদিষ্ট এলাকা রাখা।  তাদের কারণে যেন এদেশের নাগরিকদের কোন অসুবিধা নাহয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া।

লেখকঃ
মুহাম্মাদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স)
এমএসএস (অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
০১৭১২-৬৪৩১৭২

Thursday, June 13, 2019

পৃথিবীর সুন্দরী সম্রাজ্ঞী হুররাম সুলতানঃ (মহসীন ভূঁইয়া)

সম্রাজ্ঞী হুররাম সুলতানঃ
(মুহাঃ
মহসীন ভূঁইয়া)

রোক্সেলানা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। উসমানীয় সম্রাট প্রথম সুলাইমানের প্রিয়তম কানিজ হুররাম সুলতানা, জন্ম আনুমানিক ১৫০২ সালে রোহাটিন, পোল্যান্ড।
(বর্তমানে ইউক্রেনের অধীনস্থ এলাকা) মৃত্যু ১৫এপ্রিল ১৫৫৮।
(উপপত্নী) ও পরবর্তীকালে তার বৈধ স্ত্রী এবং সম্রাটের সন্তান শাহজাদা মুহাম্মদ বা মেহমেদ, মিরহিমাহ সুলতান, শাহজাদা আবদুল্লাহ, সুলতান দ্বিতীয় সেলিম,শাহজাদা বায়জিদ ও জাহাঙ্গীরের মাতা। তিনি ছিলেন উসমানীয় ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর নারীদের মধ্যে একজন এবং নারীদের সালতানাত নামে পরিচিত ও সুলতানের শাসনকালের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব। হুররেম সুলতানের হাত ধরেই উসমানীয় সাম্রাজ্যে সর্বপ্রথম নারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তার স্বামী প্রথম সুলায়মানের শাসনকালে তিনি সুলতানের প্রধান স্ত্রী বা "হাসেকি সুলতান" ছিলেন। তিনি তার স্বামীর মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করে উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এবং সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।

অটোম্যানদের মধ্যে, তিনি প্রধানত হাসেকি হুররাম সুলতান বা হুররাম হাসেকি সুলতান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জন্মভূমিতে সে পরিচিত ছিলেন রোক্সেলানা, রোক্সোলানা, রোক্সেলানে, রোসসা ও রুজিকা নামেঃ তুর্কি ভাষায় হুররাম। প্রাচীন রোক্সালানির নামানুসারে "রোক্সেলোনি" বা "রোক্সেলানি" ১৫শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউক্রেনীয়দের মাঝে একটি অন্যতম প্রচলিত নাম ছিল। সুতরাং তার ডাকনামের শাব্দিক অর্থ হল "রুথেনিয়ার ব্যক্তি"।

আধুনিক তথ্যলিপিসমুহে হুররাম সুলতানের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে তেমন কোন নির্ভর যোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না, এ সকল তথ্যভাণ্ডার হুররাম সুলতানের রুসাইন ও ইউক্রেনীয় জাতিত্ব অথবা তার জন্মস্থান হিসেবে পোল্যান্ড রাজ্যকে  উল্লেখ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১৬শ শতাব্দীর মাঝামাঝি, ক্রিমীয় খানাতে লিথুনিয়ার রাজ ডিউক জমিদারির প্রতিনিধি মিখালন লিটভাইন তার ১৫৪৮-১৫৫১ সালের রচনা "এবাউট কাস্টমস অফ তাতারস, লিথুনিয়ান্স এন্ড মস্কো বাণিজ্য বিষয়ক বর্ণনার মাঝে উল্লেখ করেন যে, বর্তমান তুর্কি সম্রাটের সবচেয়ে প্রিয়তম স্ত্রী - তার ভবিষ্যৎ পুত্রের মাতা যে তার পরবর্তীকালে শাসন করবেন, তিনি আমাদের ভূমি থেকে অপহৃত হয়েছেন

১৬শ-শতাব্দীর পরবর্তী এবং ১৭শ- শতাব্দীর শুরুর দিকে তুর্কি বিষয়ে গবেষক পোলিশ কবি সামুয়েল ত্বারদভস্কির দেয়া তথ্য অনুসারে, হুররেম সম্ভবত কোন ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স ধর্মযাজক পিতার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি পোল্যান্ড রাজ্যের রুথেনীয় ভয়ভডেশিপের প্রধান শহর ল্বও-এর ৬৮ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বের রুহাটাইন নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।  ১৫২০-এর দশকে ক্রিমিয়ার তাতাররা ঐ এলাকার একটি তড়িৎ অভিযানের সময় তাকে বন্দী করে একজন দাসী হিসেবে নিয়ে আসে (সম্ভবত প্রথমে ক্রিমিয়ার নগরী কাফফায়, যা দাস ব্যবসার একটি প্রধান কেন্দ্র, এরপর কনস্টান্টিনোপলে) এবং তাকে প্রথম সুলাইমানের হারেমের জন্য বাছাই করে।

সুলতানের সঙ্গে সম্পর্ক
অল্প সময়ের মধ্যেই রোক্সেলেনা তার মুনিব সুলায়মানের সুনজরে চলে আসেন এবং সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঈর্ষার পাত্রীতে পরিণত হন। শীঘ্রই তিনি সুলায়মানের প্রিয়তম সঙ্গিনী বা হাসেকি সুলতান হয়ে ওঠেন। সুলতানের উপর হুররামের প্রভাবের কথা দ্রুত আশেপাশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তিনিই সুলতানের সর্বাধিক সংখ্যক সন্তানের জন্ম দেন, এবং আশ্চর্যজনকভাবে চিরায়ত প্রথা ভঙ্গ করে - তিনি দাসত্ব হতেও মুক্তি লাভ করেন। দুইশত বছরের অটোম্যান ঐতিহ্যকে ভঙ্গ করে, একজন প্রাক্তন উপপত্নী এভাবে অবশেষে সুলতানের বৈধ পত্নী হয়ে ওঠে, যা প্রাসাদ ও নগরীর প্রত্যক্ষদর্শীদের জন্য অত্যন্ত হতবাককারী একটি বিষয় ছিল। এই ঘটনা সুলাইমানকে ওরহান গাজির (১৩২৬- ১৩৬২) পর প্রথম কানিজ বিবাহকারী সুলতানের পরিচয় এনে দেয় এবং প্রাসাদে হুররামের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে, যার ফলশ্রুতিতে তার অন্যতম পুত্র দ্বিতীয় সেলিম ১৫৬৬ সালে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার লাভ করেন।

ইস্তাম্বুলের হেরেমে হুররাম সুলতান সুলায়মানের প্রথম স্ত্রী, মাহিদেভরান সুলতানের একজন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। ১৫২১ সালে হুররেম তার প্রথম পুত্র মেহমেদের জন্ম দেন এবং এরপর আরও চার পুত্র, যা সুলতানের একমাত্র পুত্রের মাতা হিসেবে অর্জিত মাহিদেভরানের মর্যাদাকে ধূলিসাৎ করে দেয়।সুলায়মানের মাতা, আয়শে হাফসা সুলতান, এই দুই মহিলার শত্রুতাকে একপাক্ষিকভাবে গোপন রাখতেন, কিন্তু ১৫৩৪ সালে তার মৃত্যুর পর, একটি তুমুল লড়াই সঙ্ঘটিত হয়, যেখানে মাহিদেভরান হুররেমকে মারধর করেন। এ ঘটনায় সুলাইমান ক্ষুব্ধ হয়ে পরবর্তীতে মাহিদেভরানকে পুত্র মুস্তফা সহ প্রাদেশিক রাজধানী মানিসায় পাঠিয়ে দেন। এই নির্বাসনকে দাপ্তরিকভাবে সবার কাছে দেখানো হল যে, এটি হল সাঞ্জাক বেয়লিজি বা আপাত উত্তরাধিকারীর প্রথাগত প্রশিক্ষণ।

হুররেম এবং মাহিদেভরান মিলে সুলাইমানের ছয় পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, যাদের মধ্যে ৪ জন ১৫৫০ সালের মধ্যে জীবিত ছিল: মুস্তফা, সেলিম,বায়েজিদ, ও জাহাঙ্গীর। এদের মাঝে, মুস্তাফা ছিল বয়োজ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকারী হিসেবে হুররেমের সন্তানের অগ্রবর্তী ছিলেন। হুররেম জানতেন যে নিয়মানুসারে মুস্তাফাই সুলতান হবে, এবং তার নিজ সন্তানদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হবে। তথাপি মুস্তফাও সকল ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ বলে অনেকেই তাকে প্রাধান্য দিত এবং পারগালি ইব্রাহিম পাশাও তাকে সমর্থন করতেন, যিনি ১৫২৩ সালে সুলতানের প্রধান উজির হন। অনেক তথ্যসূত্রে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইব্রাহিম পাশা হুররেম সুলতানের চক্রান্ত ও প্রাসাদে তার উঠতি প্রভাবের একজন ভুক্তভোগী ছিলেন, বিশেষ করে অতীতে শাহজাদা মুস্তফাকে সমর্থন করার কারণে। প্রথম আহমেদের শাসনামলের আগপর্যন্ত সাম্রাজ্যে সুলতানের মৃত্যু হলে, উত্তরসূরি নির্বচনের কর্মকাণ্ডে বেসামরিক অস্থিরতা ও বিদ্রোহ প্রতিহত করতে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজপুত্রদের গোপনে বা প্রকাশ্যে হত্যা করা হতো। নিজ পুত্রদের প্রাণদণ্ডকে এড়াতে, হুররেম মুস্তাফার রাজ্যাভিষেকের সমর্থকদের নির্মূল করতে নিজ প্রভাবকে কাজে লাগাতে শুরু করলো।বহু বছর পর, সুলায়মানের দীর্ঘ শাসনামলের শেষের দিকে, তার পুত্রদের শত্রুতা আরও স্পষ্ট ও প্রকট আকার ধারণ করে। অধিকন্তু, রুস্তম পাশা ও হুররেম সুলতান উভয়ই সুলায়মানকে মুস্তফার বিরুদ্ধে উসকিয়ে দেন এবং মুস্তফাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। রুস্তম পাশা ও হুররাম সুলতান উভয়ই সুলেমানকে মুস্তাফার বিরুদ্ধে কুমন্ত্রণা দিয়ে উসকিয়ে দিতে থাকেন এবং মুস্তফাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে বার বার অভিযুক্ত করতে থাকেন। এতে করে দিন দিন মুস্তাফার উপর সুলেমানের ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে। ঐতিহাসিক সূত্র দ্বারা জানা যায় ১৫৫৩ সালে সফভীয় ইরানের বিরুদ্ধে অভিযানকালে রুস্তম পাশা সুলেমানকে অবহিত করেন মুস্তাফা বিদ্রোহ করেছেন এবং সুলেমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিশাল সৈনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। বিপরীতে মুস্তাফাকে বলা হয় ইরানের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় সুলতান সুলেমান বিপদে পরেছেন এবং শাহজাদা মুস্তাফার সহায়তা চেয়েছেন। যার পরিণতিতে মুস্তাফা তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে সুলতানকে সাহায্য করার জন্য রওনা হন।

সুলতানের তাবুর কাছে সৈন্যসমেত পৌঁছানর পর তাকে জানানো হয় ভেতরে সুলতান তার জন্য অপেক্ষা করছেন। মুস্তাফাকে নিরস্ত্র করে তাবুর ভেতরে প্রবেশ করানো হয়।

 শাহজাদা মুস্তাফা সুলতান সুলায়মানের তাবুতে প্রবেশ করলে সুলেমানের নির্দেশে আগে থেকে ওত পেতে থাকা গুপ্ত ঘাতকেরা নিরস্ত্র মুস্তাফাকে আক্রমণ করে এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।  কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে মুস্তাফার মৃত্যুর পিছনে হুররেম সুলতান এবং রুস্তম পাশার ষড়যন্ত্র সম্পূর্নই ভিত্তিহীন এবং লোক-বানানো। এই অপবাদ কোনো ইতিহাসবিদ আজও প্রমান করতে পারেননি। মুস্তাফার মৃত্যুর পর তার আস্তিনের ভেতর থেকে সুলতান সুলেমান তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা মুস্তাফার চিঠিটি পান এবং নিজের ভুল বুঝতে পারেন।

জাহাঙ্গীর, হুররেমের কনিষ্ঠ সন্তান, তার প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন বড়ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে অত্যন্ত বেদনাকাতর হয়ে পড়েন। তিনি তার প্রিয় বড় ভাইয়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। মুস্তাফার মৃত্যুতে তিনি তার বাবাকে দায়ী করেন এবং শারীরিক ও মানসিক ভাবে অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে কয়েক মাস পরেই মারা যান।

বস্তুত, সুলেমান ন্যায়বিচারক শাসক হলেও তার নিষ্ঠুর এবং ভূল সিদ্ধান্তর বলী হতে হয়েছিলো তার আপন সন্তান মুস্তাফাকে।

এছাড়াও হুররামের প্রতি তার অত্তাধিক দুর্বলতার কারনে তিনি মনে মনে চাইতেন হুররামের গর্ভের কোনো সন্তান সিংহাসনে বসুক।
মুস্তফার মৃত্যুর পর, মাহিদেভরান প্রাসাদে তার অবস্থান হারান (আসন্ন উত্তরাধিকারীর মা হিসেবে) এবং বুরসায় গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন। শেষের দিকে তার সৎপুত্র দ্বিতীয় সেলিম সুলতান হওয়ার পর (১৫৬৬) তাকে নিয়মিত ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করায় তাকে আর দারিদ্রে ভুগতে হয় নি।১৫৫৮ সালে হুররেমের মৃত্যুর পরেই কেবলমাত্র তার পুনর্বাসন সম্ভবপর হয়। কথিত আছে যে, জাহাঙ্গীর, হুররেমের কনিষ্ঠ সন্তান, তার সৎ-ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে বেদনাকাতর হয়ে কয়েক মাস পরেই মারা যান।

১৫৫৩ সালে সুলায়মান মুস্তাফাকে প্রাণদণ্ড দেয়ার পর, সৈন্যদের মধ্যে একটি বড়মাপের অসন্তুষ্টি ও অস্থিরতার উত্থান হয় যারা রুস্তম পাশাকে মুস্তফার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন। প্রজারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরে বিলাপ করতে থাকে, চারিদিকে ধিক্কার শুরু হয়ে যায়। এ ঘটনায় সুলায়মান রুস্তম পাশাকে বরখাস্ত করেন এবং ১৫৫৩ সালে কারা আহমেদ পাশা প্রধান উজির হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৫৫৫ সালে কারা আহমেদ পাশাকে দুর্নিতির দায়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় এবং রুস্তম পাশাকে আরও একবার প্রধান উজির (১৫৫৫-১৫৬১) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

সুলায়মান হুররেম সুলতানকে অটোম্যান সম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বানিয়েছিলেন আর তার সমান মর্যাদা দিয়েছিলেন। অটোম্যানের ইতিহাসে অন্য কারো সুলতানের স্ত্রীকে এই মর্যাদা দেয়া হয়নি। এমনকি সুলতান সুলেমান দরবারে সভায় হুররেমকে তার পাশে বসাতেন এবং সভায় যেকোন বিষয়ে হুররামের পরামর্শ নিতেন। এমনকি কোন অফিসিয়াল কাগজে সুলতানের পাশাপাশি সম্রাজ্ঞী হুররেম সুলতানেরও স্বাক্ষর আর সিল লাগতো।

সুলায়মান বাকি জীবনে রাজসভাতেও হুররেমকে তার সাথে থাকতে দেন, যার ফলে আরেকটি প্রথা ভঙ্গ হয়, আর তা হল, যখন সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারীগণ উপযুক্ত বয়সে পৌঁছুবে, তাঁদেরকে তাঁদের রাজ উপপত্নীসহ (উত্তরাদিকারিদেরকে তাঁদের মাতাসহ) নিকটস্থ প্রদেশে শাসনের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হবে, উক্ত উপপত্নীদের সন্তান ক্ষমতায় বসার আগ পর্যন্ত তারা ফিরে আসতে পারবে না। সুলতানের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবেও হুররেম ভূমিকা পালন করেছেন, এবং প্রতীয়মান হয় যে তিনি বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব রেখেছিলেন। রাজা সিগিসমন্ডাস দ্বিতীয় অগাস্টাসকে প্রেরিত তার দুটি চিঠি এখনো টিকে আছে, এবং স্বভাবতই তার জীবদ্দশায় পোলিশ- অটোমান মৈত্রীচুক্তির মাধ্যমে পোল্যান্ড রাজ্যের সঙ্গে অটোম্যান সাম্রাজ্যের শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল।

সুলতান সুলেইমান তার "মুহিব্বি" নামক ছদ্মনাম ব্যবহার করে হুররেম সুলতানের জন্য নিম্নোক্ত কবিতাটি লিখেছিলেন:

"আমার নির্জনতার সিংহাসন, আমার সম্পত্তি, আমার প্রেম, আমার পূর্ণিমা।
আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু, আমার সখী, আমার চিরন্তন অস্তিত্ব, আমার সুলতান, আমার একমাত্র ভালোবাসা।
সুন্দরীদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরীতমা...
আমার বসন্তকাল, আমার সদা প্রফুল্ল মুখী ভালোবাসা, আমার দিবস, আমার প্রাণের প্রিয়া, আমার হাস্যোজ্জল পত্র...
আমার গুল্ম, আমার মিষ্টি, আমার গোলাপ, এ জগতে একমাত্র সেই আমাকে কোন দুঃখ দেয়নি...
আমার ইস্তাম্বুল, আমার কারামান, আমার আনাতোলিয়ার পৃথিবী
আমার বাদাকশান, আমার বাগদাদ আর খোরাসান
আমার সুকেশী রমণী, আমার হেলানো ভুরুর প্রণয়, আমার দুষ্টুমিভরা চোখের প্রেম...
আমি সর্বদা তোমার গুণ গাইবো
আমি, এই ভগ্ন হৃদয়ের প্রেমিক, অশ্রুভরা চোখের মুহিব্বি (প্রেমিক), আমিই তো সুখী তোমাতে

হুররেম সুলতান ১৫ ই এপ্রিল ১৫৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আজো ইস্তাম্বুলের ফাতিহে অবস্থিত সুলায়মানিয়ে মসজিদে হুররেম সুলতানের তুরবে সমাধি রয়েছে। এবং ইযনিক মার্বেলপাথর দ্বারা সুসজ্জিত গম্বুজবিশিষ্ট স্বর্গের উদ্যানের আদলে তৈরি করা সমাধিতে
তাকে সমাহিত করা হয়, এটি সম্ভবত তার সদা হাস্যোজ্জল প্রকৃতির স্মৃতির প্রতি সম্মান রেখে করা হয়েছিল।সুলায়মানের সমাধির পাশেই তার সমাধি অবস্থিত, যা সুলায়মানিয়ে মসজিদের প্রাঙ্গনে অবস্থিত আরও গাম্ভীর্যপূর্ণ গম্বুজবিশিষ্ট একটি পৃথক স্থাপত্য।

হুররেম সুলতানের মূত্যুর পর সুলতান সুলেমান নিজ কাঁধে তার লাশের খাটিয়া বহন করেন। অটোম্যান সম্রাজ্যের ইতিহাসে কোনদিন কোন সুলতান তাদের স্ত্রীদের লাশের খাটিয়া বহন করেননি। একমাত্র সুলতান সুলেমান তার প্রানপ্রিয় স্ত্রী হুররেমের মৃত্যুর পর সন্তানদের সাথে হুররামের লাশের খাটিয়া বহন করে ছিলেন। হুররেমের মৃত্যুর পর সুলতান সুলেমান বেশ কয়েক দিন দুঃখে কাতর ছিলেন।

তার মৃত্যুর পর সমগ্র রাজপ্রাসাদে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তার মৃত্যুতে গরীব দুঃখীরা বেশি শোকাহত হয়েছিল। আজও তুরস্কের অনেক মানুষ হুররেমকে শ্রদ্ধার চোখে স্বরণ করে।

লেখকঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) এমএসএস (অর্থনীতি)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Friday, May 17, 2019

দানবীর হাজী মুহাম্মাদ মহসীন একজন সমাজ সংস্কারকঃ (মুহাঃ মহসীনভূঁইয়া)

দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া

হাজি মুহাম্মদ মহসিন ১৭৩২ সালে পশ্চিম বঙ্গের হুগলিতে জন্মগ্রহণ করেন, তার বাবা হাজি ফয়জুল্লাহ ও মা জয়নাব খানম। ফয়জুল্লাহ ছিলেন একজন ধনী জায়গিরদার। তাঁর পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছিল সুদূর ইরানের পারস্যে। সেখান থেকে ভাগ্য অন্বেষণে এসেছিলেন ভারত বর্ষে। তারপর স্থায়ীভাবে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি শহরে বসবাস শুরু করেন। জয়নব খানম ফয়জুল্লাহর দ্বিতীয় স্ত্রী। জয়নবেরও পূর্বে বিয়ে হয়েছিল। মন্নুজান খানম নামে তার ঘরে সাবেক স্বামী আগা মোতাহারের একটি মেয়ে ছিল। আগা মোতাহার বিপুল সম্পদের মালিক ছিলেন। হুগলি, যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায় তার জায়গির ছিল। আগা মোতাহারের সম্পত্তি তার মেয়ে মন্নুজান উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছিলেন।
গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে মহসিন ও তার সৎ বোন মন্নুজান শিক্ষার্জন করেছেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাজধানী মুর্শিদাবাদে যান। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি দেশভ্রমণের সফরে বের হন। সফরকালে তিনি হজ পালন করেন এবং মক্কা, মদিনা, কুফা, কারবালাসহ ইরান, ইরাক, আরব, তুরস্ক এমন নানা স্থান সফর করেছেন।

১৮০৩ সালে মন্নুজানের মৃত্যুর মহসিন তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পদের মালিক হন। মহসিন খুব ধার্মিক ছিলেন এবং সহজসরল জীবনযাপন করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন চিরকুমার। তার বিপুল সম্পদ দান সদকায় ব্যয় করতেন। ১৭৬৯-৭০ সালের সরকারি দলিল অনুযায়ী তৎকালীন দুর্ভিক্ষের সময় তিনি অনেক লঙ্গরখানা স্থাপন করেন এবং সরকারি তহবিলে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন।১৮০৬ সালে তিনি মহসিন ফান্ড নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করে তাতে দুইজন মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করেন।ব্যয়নির্বাহের জন্য সম্পত্তিকে নয়ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে তিনটি ভাগ ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, চারটি ভাগ পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ড এবং দুইটি ভাগ মোতাওয়াল্লিদের পারিশ্রমিকের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
হাজি মুহাম্মদ মহসিন ১৮১২ সালে হুগলিতে ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলি ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।
দানশীলতার কারণে তিনি কিংবদন্তীতে পরিণত হন এবং বর্তমানেও দানের ক্ষেত্রে তুলনা অর্থে তার দৃষ্টান্ত ব্যবহার হয়ে থাকে। পাঠকদের জন্য এই মহান ব্যক্তির কর্মময় জীবনের বিস্তারিত তুলেধরা হলো-

দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনের অবদান বাংলার ইতিহাসে অনস্বীকার্য। তিনি শুধু দানবীরই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানুষের প্রতি মায়া-মমতার মূর্ত প্রতীক। মুসলমান জনগোষ্ঠীকে উচ্চ শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘মহসিন ফান্ড’ নামক সংস্থায় গঠন করে তাঁর সর্বস্ব দান করেছিলেন। দান ও মহানুভবতার জন্য তার অবদান মানব ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

হাজি মুহাম্মদ মহসিনের মা জয়নব খানম ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের খাজাঞ্চি আগা মোতাহারের দ্বিতীয় স্ত্রী। ভাগ্যের অন্বেষণে ভারতবর্ষে আসা আগা মোতাহার সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রীর ঘরে কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনি জয়নব খানমকে সন্তান লাভের আশায় বিবাহ করেন। দীর্ঘ দিন পর মোতাহারের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নিল কন্যা সন্তান মন্নুজান। আগা মোতাহার এক সময় তাঁর মেয়ের নামে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করেন। মন্নুজান ছোট থাকায় এ দানপত্র তিনি একটি মাদুলিতে ভরে তাঁর গলায় পরিয়ে দেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তা দেখার জন্য উপদেশ দেন।
আগা মোতাহারের মৃত্যুর পর মন্নুজান সবে মাত্র কৈশোরে পদার্পন করেছে। সে মাদুলি খুলে দেখেন আগা মোতাহার তার সমস্ত সম্পদ মেয়ের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। যা দেখে জয়নব খান মন্নুজানকে হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। পরে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আগ মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহকে। এ ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেন দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিন। তখন সৎ বোন মন্নুজানের বয়স ১৩ বছর। মন্নুজানও ভাই পেয়ে মহাখুশী। হাজি মুহাম্মদ মহসিনের লালন–পালন, দেখাশুনা ও বাল্য শিক্ষা মন্নুজানের তত্ত্বাবধানেই চলতে লাগলো।

স্থানীয় মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন হাজি মুহাম্মদ মহসিন। সেখানে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষা শিখতেন। অল্প বয়সে তাঁর মেধা ও মনের গভীরতার পরিচয় পেয়ে শিক্ষকগণ অবাক হয়ে যান। চারিদিকে তার অসাধারণ মেধার কথা ছড়িয়ে পড়ে। পরে মুর্শিদাবাদের নবাব তাঁর মেধা কথা জানতে পেরে তাঁকে ডেকে পাঠান উচ্চ সরকারি পদ গ্রহণ করার জন্য। ইতোমধ্যে তাঁর পিতা মারা যান।

এদিকে বড়বোন মন্নুজান যৌবনে পদার্পন করেন। হাজি মুহাম্মদ মহসিন শিক্ষাকালে মন্নুজান হুগলিতে একাকি বাড়িতে থাকতেন। একদিকে তাঁর অনেক সম্পদ অন্য দিকে যুবতী মেয়ে। তাই কিছু দুষ্ট লোক তাঁর পেছনে ষড়যন্ত্র করতে লাগলো। মন্নুজান ষড়যন্ত্রের কথা জেনে ভাই হাজি মুহাম্মদ মহসিনকে পত্র পাঠান। পত্র পেয়ে হাজি মুহাম্মদ মহসিন বোনকে রক্ষায় বাড়ি ফিরে আসেন। ভাই মহসিনকে তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন। এবং
বোনকে সুপাত্রস্থ করার জন্য মহসিন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে হুগলিতে নবাবের নিযুক্ত ফৌজদার সালাহউদ্দিনের সঙ্গে বোনের বিবাহ দিলেন। ধন–সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত হাজি মুহাম্মদ মহসিন বোনের বিয়ের পর দেশ ভ্রমণে বের হন।
সফরকালে পবিত্র হজ পালন করে  মক্কা,মদিনা, কুফা, কারবালাসহ ইরান, ইরাক,আরব, তুরস্ক এমন নানা স্থান সফর করে দীর্ঘ ২৭ বছর পর দেশে ফিরে আসেন। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। এদিকে নিঃসন্তান বোন মন্নুজান স্বামীকে হারিয়ে বিধবা। তিনিও বার্ধক্যে উপনীত। অন্যদিকে বিশাল সম্পদের মালিক আবার একাকি নিঃসঙ্গ। বোন মন্নুজান সম্পদের পেরেশানি থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ধ্যানে জীবন কাটাতে ছোট ভাইয়ের নামে তাঁর সমস্ত সম্পদ লিখে দেন। সম্পদ লিখে দেয়া কয়েক বছর পর ১৮০৩ সালে মন্নুজান ইন্তেকাল করেন। হাজি মুহাম্মদ মহসিন ছিলেন ধার্মিক, দয়ালু  এবং দানবীর, তিনি সহজ সরল জীবনযাপন করতে পছন্দ করতেন। ৭০ বছরের হাজি মহসিন এ বিপুল সম্পদ দান সদকায় ব্যয় করার মনস্থ করলেন এবং বিশাল সম্পদ মানবতার কল্যাণে ব্যয় করেন। দেশের সকল গরীব–দুঃখী ও দুঃস্থদের সেবায় তিনি নিজের সব সম্পদ বিলিয়ে দেন। ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘মহসিন ফান্ড’ নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করে তাঁর সমুদয় অর্থ এ ফাউন্ডেশনের জন্য দান করেন। এ ফান্ডের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য দু'জন মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করেন। শুধু মোতাওয়াল্লি নিয়োগই নয়, মহসিন ফান্ডের ব্যয় নির্বাহের জন্য দানকৃত সম্পত্তিকে নয়ভাগে ভাগ করেন।
তন্মধ্যে তিনভাগ সম্পদ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য। চারভাগ সম্পদ পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে খরচ করার জন্য এবং দুইভাগ সম্পদ মোতাওয়াল্লিদের পারিশ্রমিকের জন্য বরাদ্দ করেন। তাছাড়া তাঁর দানকৃত অর্থে অসংখ্য দারিদ্র্য ছাত্রের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়।
১৮০৬ সালে তিনি তাঁর প্রায় সমস্ত ভূ–সম্পত্তি একটি ওয়াকফ দলিলের মাধ্যমে দান করে যান। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম শুরু হয়। ১৮৩৫ সালে আদালতের মাধ্যমে আইনি ঝামেলা মিটিয়ে সরকার মহসিন ট্রাস্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৮৩৫ সালেই এই ট্রাস্টের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলী মহসিন কলেজ এবং এই কলেজের সাথে হাজী মুহসীনের অর্থে পূর্বে নির্মিত দুটি স্কুলকে মিলিয়ে দেয়া হয়। উল্লেখ্য এইটিই ভারতবর্ষের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার কলেজ যেখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যেকেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। এর আগে ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ ছিল শুধু ‘the sons of respectable Hindoos’ এর জন্য এবং ১৮১৮ ও ১৮২০ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ ও বিশপস কলেজ ছিল খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী,শরৎচন্দ্র টট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ভুবনবিশ্রুত বাঙ্গালিরা সবাই এই হুগলী মহসিন কলেজের ছাত্র ছিলেন। অবশ্য ১৮৩৫ সালে ইংরেজ সরকার এর নাম হুগলী মহসিন কলেজ রাখলেও কোন এক কারণে দিনে দিনে মানুষের বলায় ও লেখায় এর নামটি দাঁড়ায় শুধু হুগলী কলেজ। মুহসীন শব্দটি ঝরে পড়ে যায়। ১৮৬০ সালের পরে কোনো কাগজপত্রে কিংবা সাইনবোর্ডে আর মুহসীন নামটা দেখাই যায় না। ১৯৩৬ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় কলেজটি মূল নামে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সে দাবি অনুযায়ী সরকারিভাবে পুনরায় কলেজটির নাম হয় হুগলি মহসিন কলেজ।
মহসিন ট্রাস্ট তথা মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড এর সৃষ্টি শুধু হুগলি মহসিন কলেজ নয়। হুগলিতে একটি হাসপাতাল নিয়মিতভাবে এই অর্থে চলছে। মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের অধিকাংশ জমি ছিল যশোর ও খুলনায়। এই ট্রাস্ট এস্টেটের জমিতে অনেকগুলো দাতব্য হাসপাতাল, সরকারি অফিস, খুলনা–কলকাতা রেললাইন ছাড়াও গড়ে ওঠে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খুলনার দৌলতপুরের সরকারি ব্রজলাল কলেজের ৪২ একর জমির ৪০ একরই মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের জমি। ব্রজলাল কলেজের অনেক আগে ১৮৬৭ সালে মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড এর অর্থে দৌলতপুরে তৈরি হয় একটি এ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল। ১৯৩৯ সালে এর নামকরণ হয় দৌলতপুর মহসিন হাই ইংলিশ স্কুল। ১৮৮৬ সালে সরকারি অর্থে খুলনা জেলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কিছুদিনেই স্কুলটি অর্থাভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে সরকারি সেই স্কুলটির জন্যও সরকার মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেট থেকে অর্থ মঞ্জুর করেন। এছাড়াও মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের অর্থে খুলনার দৌলতপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় মহসিন বালিকা বিদ্যালয় ও মহসিন মহিলা কলেজ।

১৮৭৪ সালে মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড এর অর্থে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে তিনটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার মাদ্রাসাটি এখন সরকারি কবি নজরুল কলেজ ও চট্টগ্রামের মাদ্রাসাটি এখন হাজি মহম্মদ মহসিন কলেজ। আর রাজশাহীরটি এখন রাজশাহী গভর্নমেন্ট মাদ্রাসা নামে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে ইসলামি শিক্ষা শাখায় আই এ সার্টিফিকেট প্রদানের প্রতিষ্ঠান রূপে চলছে।
নবাব আব্দুল লতিফ, নবাব খাজা আব্দুল গণি প্রমুখের আবেদন নিবেদনের ভিত্তিতে ১৮৭৩ সালে সরকার মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ডের অর্থে স্কলারশিপ মঞ্জুরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকার আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে-যশোর, রংপুর,পাবনা, ফরিদপুর, বাকরগঞ্জ, ময়মনসিংহ,নোয়াখালি ও সিলেট জেলার স্কুলগুলোতে মুসলিম ছাত্রদের দুই তৃতীয়াংশ বেতন ও একজন আরবি শিক্ষকের বেতন এই ফান্ড খেকে দেয়া হবে। ১৯৩১ সালে বেঙ্গল এডুকেশন কোড মহসিন ফান্ডের বৃত্তির পরিমাণ ও সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে দেয়।
ধন–সম্পদের প্রতি নির্লোভ বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিন ১৮১২ সালে ৭৯ মতান্তরে ৮০ বছর বয়সে হুগলির নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলির ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।
এ মহান দানবীর তাঁর অসামান্য দানের কারণে কিংবদন্তীতে পরিণত হন। তাঁর স্মরণে হুগলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি কলেজ। বাংলাদেশের ‘চট্টগ্রাম সরকারি হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজ’ প্রতিষ্ঠা হয় তাঁর ওয়াকফকৃত অর্থ থেকে প্রাপ্ত অনুদানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মহসিন হল’ এবং ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি ‘বিএনএস হাজি মহসিন’ও তাঁর স্মরণে নামকরণ করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যেকজন দানবীর মহামানবের নাম আসবে, তাদের মধ্যে বাংলার মহান দানবীর ও মুসলিম শিক্ষাজাগরনের অগ্রদূত হাজি মুহাম্মদ মহসীন অন্যতম একজন। তিনি ছিলেন, ব্যক্তিজীবনে ধর্মপরায়ন এবং সামাজিক জীবনে দানবীর ও শিক্ষানুরাগী। বাংলা তথা ভারত বর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থায় হাজি মুহাম্মদ মহসীনের অবদান অতুলনীয় ও অনস্বীকার্য।

লেখকঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) এমএসএস (অর্থনীতি)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।  mohsinbhuiyan1980@gmail.com
01712-643172

বিশ্ব নবীর বিদায় হজ্জের ভাষণঃ (মুহাম্মাদ মহসীনভূঁইয়া)

বিশ্ব নবীর বিদায় হজ্জের ভাষণঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

নবী মুহাম্মদ (সঃ) আরাফাত ময়দানে ১০ যিলহজ্জ তারিখ কাসওয়া উটনীর পিঠে আসন গ্রহণ করেন, সে সময় প্রায় এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার সাহাবী তাঁর চারদিকে সমবেত ছিল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে মানবতার মহান মানব, হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সঃ) বলেন-
হে লোক সকল,  আমার কথা শোনো, আমি জানিনা, এবারের পর আমি তোমাদের সাথে এই জায়গায় আর মিলিত হতে পারবো কিনা।
তোমাদের রক্ত ও ধন-সম্পদ পরস্পরের জন্য আজকের দিন, বর্তমান মাস এবং এই শহরের মতই নিষিদ্ধ। শোনো মানুষ সকল, জাহেলিয়াত যুগের সবকিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের খুনও খতম করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে রক্ত আমি শেষ করেছি তা হচ্ছে, রবিয়া ইবনে হারেসের পুত্রের রক্ত। জাহেলী যুগের সুদ খতম করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে সুদ আমি খতম করেছি তা হলো, আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেবের সুদ, এখন থেকে সুদ শেষ করে দেওয়া হলো। আর নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, তোমারা তাদের আল্লাহর আমানতের সাথে গ্রহণ করেছো, আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে হালাল করেছো। তাদের উপর তোমাদের অধিকার,  তারা তোমাদের বিচানায় এমন কাউকে আসতে দিবেনা যাদের তোমরা পছন্দ করোনা। তোমাদের উপর তাদের অধিকার, তোমরা তাদের ভালো পানাহার ও পোশাক দিবে।
তোমাদের কাছে আমি এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা ধারণ করে থাকো তবে কখনও পথভ্রষ্ট হবেনা "তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব"।
মনে রেখো আমার পর কোন নবী নেই, তোমাদের পর কোন উম্মত নেই। আল্লাহর ইবাদত করবে, নামায আদায় করবে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, আনন্দের সাথে নিজ সম্পদের যাকাত দিবে, আল্লাহর ঘরে হজ্জ করবে, নিজ শাসকদের আনুগত্য করবে, যদি এরুপ করো, তবে আল্লাহর জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তোমাদেরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা কি বলবে ?
লক্ষ সাহাবী সমস্বরে বললেন, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি,  আপনি তাবলীগ করেছেন, পয়গাম পৌছে দিয়েছেন, কল্যাণ কামনার হক আদায় করেছেন। এ কথা শুনে বিশ্ব নবী মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) নিজের শাহাদাত আঙুল আকাশের দিকে তুলে লোকদের দিকে ঝুঁকে তিনবার বলেন, হে আমার রব, তুমি সাক্ষী থেকে।
তাঁর কথাগুলো হযরত রবিয়া ইবনে উমাইয়া ইবনে খালাফ উচ্চকণ্ঠে উপস্থিত সবার কাছে পৌছে দিচ্ছিলেন।  আর আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর সেদিনের সাথীরা অঝোরে কান্না করছিলো। হযরত ওমর (রাঃ) কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, পূর্ণাঙ্গতার পরতো অপূর্ণাঙ্গতাই থেকে যায়।
ভাষণ শেষ করার পর আল্লাহ তায়ালা কুরআনের আয়াত নাযিল করেন- "আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাংগ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পর্ণ করলাম, ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম"।
(সুরা মায়েদা, আয়াত-০৩)

লেখকঃ
মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স)
এমএসএস (অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Thursday, May 16, 2019

কাগমারী সম্মেলন ও মাওলানা ভাসানীঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

কাগমারী সম্মেলন ও মাওলানা ভাসানীঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় সম্মেলন, পরবর্তীতে পাকিস্তানের 
বিভক্তি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে বিশেষ ইঙ্গিতবহ ভূমিকা রেখেছিল এই সম্মেলন। ১৯৫৭ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেলার কাগমারী নামক স্থানে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ৮ই ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। উক্ত সম্মেলনে ভাসানী পাকিস্তানী শাসকদের হুশিয়ার করে বলেন, যদি পূর্ব পাকিস্তানে শোষণ অব্যাহত থাকে তবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে “আসসালামু আলাইকুম ” জানাতে বাধ্য হবেন এবং তিনি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরোধিতা করে বলেন, এই চুক্তি জনগন মানেনা, মানতে পারেনা। কাগমারী সম্মেলনে প্রদত্ব বক্তব্যে মওলানা ভাসানী শেষ পর্যায়ে রেগে উঠে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কে লক্ষ্য করে বলে ছিলেন 'শহীদ, তুমি আজ আমাকে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সমর্থন করতে বলছো। তুমি যদি আমাকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো, আমি বলবো, 'না'! তুমি যদি আমাকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো আমি বলবো 'না'! 'না'! তুমি যদি আমাকে আমার কবরে গিয়েও জিজ্ঞাস করো সেখান থেকে আমি চিৎকার করে বলবো 'না' 'না'। 
এই সভায় মওলানা ভাসানী তাঁর বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে। এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সাময়িক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহ্‌রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে, ১৮ই মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে মাওলানা ভাসানী পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫শে জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর পর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৭-র ৭ই অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ই অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকার কারাগারে ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।

লেখকঃ
মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) 
এমএসএস (অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লাহ আমাদের চেতনার অনুপ্রেরণাঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লাহ আমাদের স্বাধীনতার অনুপ্রেরণাঃ  (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

শহীদ তিতুমীর, যাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী (জন্ম ২৭শে জানুয়ারী ১৭৮২, মৃত্যু ১৯শে নভেম্বর,১৮৩১) তার পিতার নাম সৈয়দ মীর হাসান আলী ও মাতার নাম আবিদা রুকাইয়া খাতুন। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ও কৃষক প্রজার নেতা। ওয়াহাবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এই মহান বিপ্লবী । জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরূদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও বাঁশের কেল্লার নির্মাণের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় এই বাঁশের কেল্লাতেই ১৯ নভেম্বর ১৮৩১ সালে ৪৯ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান এবং সেখানে স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে (১৮২৭) তিতুমীর তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে 'তাহ্‌বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত 'দাঁড়ির খাজনা' এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। আগেই তিতুমীর পালোয়ান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন।
তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় পাঁচ হাজারে গিয়ে পৌঁছায় এবং তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়।
১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসাতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেল বাড়িয়া গ্রামে বাঁশ ও কাদা দিয়ে তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন।

তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। ঐ বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন, "ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।"১৪ নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের আক্রমণ করে। তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। ১৪শে নভেম্বর তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তাঁর বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
অনেক ঐতিহাসিক তিতুমীরের লড়াইকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় আখ্যা দেন কারণ মূলত হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতু যুদ্ধঘোষণা করেছিলেন। একথা সত্য তিতুমীর প্রজাদের একজোট করেছিলেন ধর্ম এবং জেহাদের ডাক দিয়েছেন। অত্যাচারী হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে আক্রমন, দেবনাথ রায় হত্যা, গো হত্যা ইত্যাদির উদাহরণ হিসেবে টানা যায়। অপরপক্ষে অমলেন্দু দে'র ভাষায় তিতুমীরের লক্ষ্য ও পথ ছিল ইসলামে পূর্ন বিশ্বাস এবং হিন্দু কৃষকদিগকে সাথে নিয়ে ইংরেজ মদতপুষ্ট জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা। তিতুমীরের আক্রমের লক্ষ্যবস্তু হিন্দুদের পাশাপাশি ধনী মুসলমানও ছিল। তার বক্তৃতা শোনার জন্যে দলে দলে হিন্দু মুসলিম কৃষক জমা হতো। তিতুমীরের এই সংগ্রাম ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ যার অভিমুখ ছিল অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবরা। শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লার আন্দোলন ছিল,এক কথায় ভারতবর্ষে ইংরেজ, জমিদার ও হিন্দু মহাজনদের অত্যাচারের বিরোদ্ধে কৃষক জনতার স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলন। যে ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ এ আমরা স্বাধীনতার প্রথম সোফান অর্জন করেছি।

মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস(অনার্স)এমএসএস(অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Wednesday, May 15, 2019

ধর্মীয় সংস্কার ও ফরায়েজি আন্দোলনঃঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

ধর্মীয় সংস্কার ও ফরায়েজি আন্দোলনঃ
(মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

হাজী শরীয়তুল্লাহর জন্ম হয়েছিল ১৭৮১ সালে বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলায় চর শামাইল (বাহাদুরপুর) গ্রামের এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে। আর মৃত্যুবরণ করেন ১৮৪০ সালে। তিনি মক্কা শরীফে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে হজ পালনের গমন করেন, এবং মক্কায় প্রায় ২০ বছর অবস্থান করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে বাংলায় ফিরে আসেন।
তিনি একজন আরবি ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। এছাড়াও ধর্মীয় সংস্কারক, নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী নেতা এবং ভারতবর্ষে সংঘটিত ফরায়জি আন্দোলন তারই নেতৃত্বে হয়েছিল। তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, ছিলেন কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনার প্রধান সংগঠক ও নেতা।

দেশে ফিরে তিনি আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের আদলে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। নীলকর ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তার প্রবর্তিত ধর্মমত ছিল আধুনিক ও মানবতাবাদী। মুসলিম ধর্মের উৎপীড়নমূলক নিয়ম রদ করে ভন্ড মোল্লা মৌলবীদের হাত থেকে তার শিষ্যদের রক্ষা করেন। একারনে রক্ষণশীল ধনী মুসলমানেরা তাকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার অসংখ্য কৃষক তার শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিল। তার ছেলে দুদু মিয়াও একজন ঐতিহাসিক যোদ্ধা এবং ফরায়েজী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এদেশ থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানোতে ভূমিকা রেখেছেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ'র নামানুসারে বাংলাদেশের শরিয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া তার নামে মাদারিপুরের শিবচরে আড়িয়াল নদীর উপরে নির্মিত সেতুটির নাম করণ করা হয়েছে-
"হাজী শরীয়তুল্লাহ সেতু"

ফরায়েজী আন্দোলন  ঊনিশ শতকে বাংলায় গড়ে ওঠা একটি সংস্কার আন্দোলন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ধর্ম সংস্কার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনে আর্থ-সামাজিক সংস্কারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফরায়েজী শব্দটি ‘ফরজ’ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কাজেই ফরায়েজী বলতে তাদেরকেই বোঝায় যাদের লক্ষ্য হচ্ছে অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ কার্যকর করা।
এ আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি অবশ্য শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, অবশ্য পালনীয়ই হোক বা ঐচ্ছিকই হোক, কুরআন ও সুন্নার নির্দেশিত সকল ধর্মীয় কর্তব্যই এর অন্তর্ভুক্ত। শরীয়তউল্লাহ হজ্ব পালনের জন্য মক্কায় যান এবং সেখানে  হানাফি শাস্ত্রজ্ঞ শেখ তাহির সোম্বলের নিকট ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। দেশে ফিরে তিনি দেখতে পান যে, বাংলার মুসলমানদের একটি অংশ বহুবিধ স্থানীয় লোকাচার ও পর্ব-উৎসব পালনে উৎসাহী হয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার প্রতি চরম উদাসীন হয়ে উঠেছেন। সে কারণেই তিনি ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেন এবং কালক্রমে এ আন্দোলন সমগ্র পূর্ববঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

হাজী শরীয়তউল্লাহ বাংলায় ব্রিটিশ শাসনকে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করতেন। হানাফি আইনের অনুসরণে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বাংলায় বৈধভাবে নিযুক্ত একজন মুসলিম শাসকের অনুপস্থিতি মুসলমানদের জুমআর নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠানের সুযোগ হতে বঞ্চিত করেছে। এ মত ছিল ফরায়েজী আন্দোলনের একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য যা একে ওই সময়ের অপরাপর পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন থেকে আলাদা করে তুলেছে।

হাজী শরীয়তউল্লাহ মনে করতেন, আজ বাংলার মুসলিম সমাজ নিজেদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে উদাসীন ও অসচেতন। মুসলমান কৃষকদের আত্মসচেতন ও উজ্জীবিত করার কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি ছিলেন, একজন একনিষ্ঠ ধর্মপ্রচারক ও সহানুভূতিশীল কৃষক দরদী । ফরায়েজী আন্দোলন অসামান্য দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা, ফরিদপুর,বরিশাল,ময়মনসিংহ, কুমিল্লা,চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলাসমূহে এবং আসাম প্রদেশে বিস্তারলাভ করে। যেসব এলাকায় নব্য হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরগণ শক্তিশালী ছিল এবং কৃষকদের উপর অত্যাচার চালাত সেসকল এলাকায় এ আন্দোলন সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

কিন্তু সমকালীন বাঙালি সমাজে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ফরায়েজী আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলতে পারেনি। ভূস্বামী শ্রেণি এর স্বার্থ রক্ষার্থে ফরায়েজী ও রক্ষণশীল গোঁড়া মুসলমানদের মধ্যে বিরোধে হস্তক্ষেপ করে। ঢাকার জমিদারগণ পুলিশের সহায়তায় রামনগরে অবস্থিত প্রচারকেন্দ্র থেকে শরীয়তউল্লাহকে বহিষ্কার করেন। হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের সঙ্গে অবিরাম সংঘর্ষের ফলে আন্দোলনটি ক্রমান্বয়ে আর্থ-সামাজিক রূপে চুয়ান্ত সফল হয়নি।

উনিশ শতকে মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নব্য জমিদারগণ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয় এমন বহু অতিরিক্ত অবৈধ কর কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেয়। এমনকি, তারা মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে  কালীপুজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য কর আদায় করত। শরীয়তউল্লাহ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং জমিদারদের এসকল অবৈধ কর প্রদান না করার জন্য তার শিষ্যদের নির্দেশ দেন। জমিদার গণ ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরু জবাইয়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। গরু কোরবানি করা মুসলমানদের প্রচলিত ধর্মীয় প্রথা এবং মুসলমানদের খাদ্য হিসেবে অন্যান্য মাংসের তুলনায় গরুর মাংসের মূল্য কম বিধায় শরীয়তউল্লাহ এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার জন্য মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেন।

কলকাতার সংবাদপত্র এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনাকালে ফরায়েজীদের বিদ্রোহী ভাবাপন্ন দল হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচারাভিযান শুরু করে। ১৮৩৭ সালে জমিদারগণ শরীয়তউল্লাহকে তিতুমীর এর ন্যায় একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তারা ফরায়েজীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করে এবং এ কাজে তারা ইউরোপীয় নীলকরদের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করে। কিন্তু তাদের অভিযোগসমূহ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হওয়ায় কোন অভিযোগই আদালতে প্রমাণ করতে পারে নি। অবশ্য ফরিদপুরে শান্তিভঙ্গ ও গোলযোগ সৃষ্টির অভিযোগে ১৮৩৯ সালে শরীয়তউল্লাহ একাধিকবার পুলিশি হেফাজতে ছিলেন।

১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র মুহসীন উদ্দীন ওরফে দুদু মিয়াকে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা ঘোষণা করা হয়। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তো সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রণোদিত একটি জমিদার শ্রেণি গড়ে তোলে। প্রজাদের কাছ থেকে জোর করে যতটা সম্ভব অর্থ আদায় করা ছাড়া অপর কোন চিন্তাই তাদের ছিল না। তারা বহুসংখ্যক লাঠিয়াল পুষত এবং তাদের সাহায্যে প্রজাদের উপর নির্যাতন চালাত।

এ ব্যবস্থা জমিদারদের বস্ত্তত সামন্তাধিকার প্রদান করে এবং কৃষক শ্রেণিকে প্রায় ভূমিদাসে পরিণত করে। কলকাতার আদালত ছিল দরিদ্র কৃষকদের আওতার বাইরে। জমিদারদের যৌক্তিক পথে আনার জন্য শক্তি প্রয়োগ ছাড়া দুদু মিয়ার আর কোন উপায় ছিল না। তিনি কানাইপুরের শিকদার পরিবার ও ফরিদপুরের ঘোষদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এরূপ এক সংঘর্ষে মদন ঘোষ নিহত হন। এর ফলে ১১৭ জন ফরায়েজী আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন এবং তাদের মধ্যে ২২ জন দায়রা জজ কর্তৃক ৭ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন। দুদু মিয়া সহ অন্যান্যরা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।

দুদু মিয়ার এই প্রাথমিক বিজয় জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাদের কাছে তাঁর সম্মান অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ঘটনাপ্রবাহ ফরায়েজী আন্দোলনের প্রসারে আরও প্রেরণা যোগায়। এতদিন যেসব মুসলমান আন্দোলন থেকে দূরে ছিল শুধু তারাই যে এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তা নয়, জমিদারদের বিরুদ্ধে দুদু মিয়ার সাহায্য লাভের জন্য হিন্দু ও দেশীয় খ্রিস্টানগণও এ আন্দোলনে যোগ দেয়।

জমিদারদের প্ররোচনায় এন্ড্রু ডানলপ্ নামের একজন প্রভাবশালী নীলকর দুদু মিয়ার চরম শক্রতে পরিণত হয়। কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলাল নামের  এক মাড়োয়ারি হিন্দু পাঁচচরে ডানলপের নীলকুঠির গোমস্তা ছিলেন। ১৮৪৬ সালের অক্টোবর মাসে পাঁচচরের হিন্দু বাবুদের সঙ্গে মিলে আনুমানিক সাত-আটশ’ লোক নিয়ে কাঞ্জিলাল বাহাদুরপুরে দুদু মিয়ার বাড়ি আক্রমণ করেন। দুদু মিয়ার অভিযোগ মতে তারা সামনের দরজা ভেঙে ফেলে, চার জন পাহারাদারকে হত্যা করে এবং অন্যান্যদের মারাত্মকভাবে জখম করে নগদ অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ কেড়ে নেয়। ঘটনাটি পুলিশকে জানালে হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে শুধুমাত্র আহত ব্যক্তিদের বিচারার্থে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রেরণ করেন।

ডানলপের গোমস্তা কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলালের সঙ্গে এ সংঘর্ষের কারণে দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করে দায়রায় সোপর্দ করা হয়। দায়রা আদালত দুদু মিয়া ও তার ৪০ জন অনুসারীকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করে। কিন্ত প্রদত্ত গুরুদন্ড এ আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় রায়টি অনুমোদনের জন্য কলকাতায় সদর নিজামত আদালতে প্রেরণ করা হয়। সদর নিজামত আদালত ফরিয়াদির অভিযোগের বর্ণনা অংশত চরম অবাস্তব এবং অংশত একদম অবিশ্বাস্য বলে মনে করে। ফলে তারা সবাই খালাস পেয়ে যান। দুদু মিয়ার অনুসারিগণ একে নিপীড়িত কৃষককুলের জন্য এক মহাবিজয় বলে স্বাগত জানায়।

১৮৬২ সালে দুদু মিয়া মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার নাবালক পুত্র গিয়াসউদ্দীন হায়দার ও আবদুল গফুর ওরফে নয়া মিয়ার তত্ত্বাবধানের জন্য একটি অভিভাবক পরিষদ গঠন করেন। এ দুই পুত্র পরপর ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। পরিষদ ক্ষীয়মান আন্দোলনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। নয়া মিয়ার বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে এবং তার নেতৃত্বে আন্দোলন হারানো শক্তি কিছুটা ফিরে পায়। মাদারীপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক নবীনচন্দ্র সেন বিচক্ষণতার সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তিতে ফরায়েজী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তোলেন। ফরায়েজী নেতৃবৃন্দও তাদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করে।

১৮৮৪ সালে নয়া মিয়ার মৃত্যুর পর দুদু মিয়ার তৃতীয় ও কনিষ্ঠতম পুত্র সৈয়দউদ্দীন আহমদ ফরায়েজীদের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর সময়ে তাইয়ুনি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফরায়েজীদের সংঘর্ষ চরমে পৌঁছে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় বিতর্ক পূর্ববঙ্গে নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। সরকার সৈয়দউদ্দীনকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এর প্রশ্নে তিনি বিভাজনের পক্ষে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। কিন্তু ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

খান বাহাদুর সৈয়দউদ্দীনের পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র রশিদউদ্দীন আহমদ ওরফে বাদশা মিয়া ফরায়েজী নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর নেতৃত্বের প্রথমদিকে বাদশা মিয়া সরকারের প্রতি সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ তাকে ব্রিটিশ বিরোধী করে তোলে এবং তিনি খেলাফত ও অসহযোগী আন্দোলনে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি নারায়ণগঞ্জে ফরায়েজীদের এক সম্মেলন আহবান করে পাকিস্তানকে ‘দারুল ইসলাম’ বলে ঘোষণা করেন এবং তার অনুসারীদের জুমআ ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করেন।

ফরায়েজীগণ তাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মানুশীলনে কতিপয় স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যসহ হানাফি মযহাবের অনুসারী ছিল। ঐ বৈশিষ্ট্যগুলিকে মোটামুটি পাঁচটি ফরায়েযী মতবাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়:
১. তওবা অর্থাৎ আত্মার পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে অতীত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।
২. ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ কঠোরভাবে পালন করা। ৩. কুরআন নির্দেশিত তৌহিদ বা একেশ্বরবাদ।
৪. ভারতবর্ষ ‘দারুল হরব’ বিধায় এখানে জুমআ ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠান অত্যাবশ্যকীয় নয়।
৫. কুরআন ও সুন্নাহ বহির্ভূত সকল লোকাচার ও অনুষ্ঠানকে ‘বিদাত’ বলে পরিহার করা।
পীর ও ‘মুরিদ’ অভিধার পরিবর্তে ফরায়েজীদের নেতাকে ‘ওস্তাদ’ বা শিক্ষক এবং তার অনুসারীদের ‘শাগরিদ’ বা শিষ্য বলা। ফরায়েজী জামায়াতে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিকে ‘তওবার মুসলিম’ বা ‘মুমিন’ বলা।

ফরায়েজীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে দুদু মিয়ার দুটি লক্ষ্য ছিল: ১. হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার থেকে ফরায়েজী কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষা করা এবং ২. জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য তিনি এক স্বেচ্ছাসেবক লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন এবং তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি অর্জনের জন্য তিনি ফরায়েজীদের নেতৃত্বে সনাতন স্থানীয় সরকারব্যবস্থা (পঞ্চায়েত) পুনঃপ্রবর্তন করেন। প্রথমোক্তটি ‘সিয়াসতি’ বা রাজনৈতিক শাখা এবং পরেরটি ‘দ্বীনি’ বা ধর্মীয় শাখা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ দুটি শাখা একীভূত করে ‘খিলাফত’ ব্যবস্থার রূপ দেওয়া হয়।

ফরায়েজী খিলাফত পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল সকল ফরায়েজীকে দুদু মিয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের (খলিফা) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা। খলিফাদের এই পরম্পরায় সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ‘ওস্তাদ’ দুদু মিয়া। তিনি তিন পদমর্যাদার খলিফা নিয়োগ করেন: উপরস্থ খলিফা, তত্ত্বাবধায়ক খলিফা ও গাঁও খলিফা।

দুদু মিয়া ফরায়েজী বসতি এলাকাকে ৩০০ থেকে ৫০০ পরিবারের এক একটি ছোট এককে বিভক্ত করেন এবং প্রতি এককে একজন গাঁও বা ওয়ার্ড খলিফা নিযুক্ত করেন। অনুরূপ দশ বা তদোধিক একক নিয়ে একটি সার্কেল বা গির্দ গঠিত হতো। প্রতিটি সার্কেল বা গির্দে একজন করে তত্ত্বাবধায়ক খলিফা নিয়োজিত হতেন। তত্ত্বাবধায়ক খলিফাকে একজন পিয়ন ও একজন পেয়াদা বা পাহারাদার দেওয়া হতো। এই পিয়ন ও পেয়াদারা একদিকে তত্ত্বাবধায়ক খলিফার সঙ্গে গাঁও খলিফাদের এবং অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক খলিফা ও ওস্তাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত। ‘উপরস্থ খলিফা’গণ ছিলেন ওস্তাদের উপদেষ্টা এবং তারা ফরায়েজী আন্দোলনের প্রধান কার্যালয় বাহাদুরপুরে ওস্তাদের সঙ্গে অবস্থান করতেন।

গাঁও খলিফা একজন সমাজপতির ভূমিকা পালন করতেন যার দায়িত্ব ছিল ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তার, ধর্মীয় কর্তব্য পালনে লোককে উদ্বুদ্ধ করা, খানকাহও মসজিদ সংরক্ষণ, নৈতিকতা পর্যবেক্ষণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচারকার্য সম্পন্ন করা। কুরআন শিক্ষা এবং ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের লক্ষ্যে একটি মকতব পরিচালনাও তার দায়িত্ব ছিল। তত্ত্বাবধায়ক খলিফার প্রধান দায়িত্ব ছিল গাঁও খলিফাদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করা, তার অধীনস্থ গির্দের ফরায়েজীদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখা, ধর্মের মৌলনীতি প্রচার এবং সর্বোপরি গাঁও খলিফাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোন আপিল মামলার নিষ্পত্তি করা। এরূপ ক্ষেত্রে তিনি তার গির্দের খলিফাদের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদে বসে আপিল মামলার শুনানি গ্রহণ করতেন। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সকল বিষয়ে দুদু মিয়ার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত এবং ওস্তাদ হিসেবে তিনি চূড়ান্ত আপিল আদালত হিসেবে কাজ করতেন।

ফরায়েজী আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক দিক হলো নবসৃষ্ট জমিদারদের নিপীড়ন প্রতিরোধের জন্য জনগণের একটি সুসংগঠিত পদক্ষেপ। এতে জমিদার ও নীলকরদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষক সম্প্রদায়ের অসন্তোষের তীব্রতার প্রতিফলন ঘটেছে। এটি ছিল জনতার কাতার থেকে এক ধরনের সফল নেতৃত্ব গড়ে উঠার একটি উদাহরণ।

লেখকঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) এমএসএস (অর্থনীতি)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।