Sunday, July 21, 2019

সাবধান ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা বেঈমানঃ মুহাম্মাদ মহসীন ভূঁইয়া

সাবধান
ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা  বেঈমানঃ

(মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া)

আরাকানে বসবাস কারী  কিছু সংখ্যক মুসলিম ও হিন্দু স্থায়ী অধিবাসীদের রোহিঙ্গা বলা হয়ে থাকে, রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের পূর্বে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারি হলেও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারিও রয়েছে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে বার্মার জান্তা সরকার একটি ঘোষণার মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেন। আমার লেখায় এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক পরিচয় ও বাংলাদেশ তথা ভারত বর্ষের সাথে তাদের সম্পর্কের কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

বর্তমানে রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবস্থানের প্রাথমিক চিত্র হলো- (১৫০০০০০–২০০০০০০) লক্ষ রোহিঙ্গা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চলসমূহ মধ্যে মায়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, সৌদি আরব।

মায়ানমার (১০০০০০)
বাংলাদেশ (১১০০,০০০)
পাকিস্তান (২০০,০০০)
থাইল্যান্ড (১০০,০০০)
মালয়েশিয়া (৪০,০৭০)
ভারত (৪০,০০০)
যুক্তরাষ্ট্র (১২,০০০)
ইন্দোনেশিয়া (১১,৯৪১)
সৌদিআরব (৩ থেকে ৫ লক্ষ)
নেপাল (২০০)

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ সালের আইন করে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে মায়ানমার জান্তা সরকার। ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহি

ঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। এছাড়াও তাদের রাজনীতি, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো দমন ও নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূলতা হিসেবে অাখ্যা দিয়েছে।

এবং যেখানে গণহত্যার মত অপরাধের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যেতে পারে মতপ্রকাশ করেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত মায়ানমারের বিশেষ তদন্তকারী ইয়ং হি লি-বিশ্বাস করেন, মায়ানমার পুরোপুরি তাদের দেশ থেকে রোহিঙ্গা জাতি গোষ্ঠীকে বিতড়িত করতে চায়।

২০০৮ সালের সংবিধান অনুসারে, মায়ানমারের সেনাবাহিনী এখনো সরকারের অধিকাংশ বিষয় নিয়ন্ত্রন করে থাকে যার মধ্যে অন্তুর্ভূক্ত রয়েছে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেনাবাহিনীর জন্য সংসদে ২৫% আসন বরাদ্দ রয়েছে এবং তাদের জন্য উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সংরক্ষিত থাকবেন।

মায়ানমার সরকারের এই অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী আচরণের পর থেকে রোহিঙ্গারা বার বার বলে আসছে, তারা পশ্চিম মায়ানমারে অনেক আগে থেকে বসবাস করে আসছেন। তাদের বংশধররা প্রাক-উপনিবেশিক ও উপনিবেশিক আমল থেকে আরাকানের বাসিন্দা ছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে নির্যাতন শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রোহিঙ্গারা আইনপ্রণেতা ও সংসদ সদস্য হিসেবে মায়ানমারের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পূর্বে যদিও মায়ানমার রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করত কিন্তু হঠাৎ করে মায়ানমার সরকারের মনোভাব বদলে যায় এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মায়ানমার সরকারের অফিসিয়াল মন্তব্য হলো তারা মায়ানমার জাতীয় জনগোষ্ঠী নয় বরং তারা বাংলাদেশ  থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। মায়ানমারের সরকার তখন থেকে “রোহিঙ্গা” শব্দটি ব্যবহার বন্ধ করে তাদের বাঙ্গালী বলে সম্বোধন করে আসছে। রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আরাকান রোহিঙ্গা জাতীয় সংস্থা বহুদিন থেকে তাদেরকে মায়ানমারের মধ্যে জাতিসত্ত্বার পরিচয় দেওয়ার দাবী করে আসছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংগঠন "জাতিসংঘ" তাদের তদন্তের প্রতিবেদনে বলেন, রোহিঙ্গারা মায়ানমারের ভিতরে অতি-জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের দ্বারা ঘৃণা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার শিকার হচ্ছে। একই সাথে মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত গণহত্যা, অবৈধ গ্রেফতার, নির্যাতন, ধর্ষণ, গুমখুন এবং অপব্যবহারের শিকার হওয়ার পাশাপাশি তাদের জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করছেন। জাতিসংঘের মতানুসারে, রোহিঙ্গাদের উপর চলা এ নির্যাতনকে মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে বলা যেতে পারে।

২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালের সেনাবাহিনীর অভিযানের পূর্বে মায়ানমারে ১.১ থেকে ১.৩ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাস করতেন। যাদের অধিকাংশের বাসস্থান ছিল মুলত ৮০-৯৮% রোহিঙ্গা অধ্যূষিত রাখাইন রাজ্যে। ১০০০,০০০ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে দক্ষিণ-পূর্বের পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিবেশী দেশসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ১০০,০০০-এর বেশি রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচুত হয়ে মায়ানমারের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে রয়েছে। ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় ১২ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলে মায়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরোদ্ধে “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” শুরু করে। এই অপারেশনে প্রায় (২০০০০) বিশ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হন, অনেক রোহিঙ্গা আহত, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন। তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ১০-১২ লক্ষ এর বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

রোহিঙ্গাদের প্রকৃত সংখ্যা কত হবে
তা নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিস্তর ফারাক জাতিসংঘ ও অন্যান্যদের। ইউএনএইচসিআরের মতে বাংলাদেশে ৫ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও এনজিও প্রতিনিধিরা বলছেন, নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। তাদের যুক্তি হলো, ইউএনএইচসিআর তাঁবু ধরে যে প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গার সংখ্যা নির্ধারণ করছে, বাস্তবতা তার  ভিন্ন।

রোহিঙ্গাদের একটি অংশ তাঁবুর বাইরে অবস্থান করছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন স্থানে গভীর অরণ্যেও নিজেদের মতো করে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। সেখানে কোনো জরিপ চালানো হয়নি।
এ ছাড়া একটি অংশ কক্সবাজারে আত্মীয়স্বজনদের বাসায়ও উঠেছে। এগুলোও গণনার বাইরে।
বর্তমানে প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হলেও বাস্তবে এর চেয়ে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এই বিশাল সংখ্যক অভিবাসী ঐ জনপদে এদেশের নাগরিকদের সাথে সহাবস্থানের আছে।

মায়ানমার সরকার ও বৌদ্ধ চরমপন্থীদের দ্বারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময় নির্যাতনের ও গণহত্যার শিকার হয়েছে। এবার এর কিছু চিত্রের তথ্য দিবো।

ধর্মীয় ও জাতিগত নিধনের উদ্দেশ্যে
২০১৬-১৭ মায়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বা নিপীড়ন হয়েছে ব্যাপক হারে, মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশের দ্বারা দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমান ও হিন্দু জনগোষ্ঠির উপর চালানো হয় সামরিক অভিযান।  এটি ২০১২ সালের অক্টোবরে অজ্ঞাত বিদ্রোহীর দ্বারা বার্মা সীমান্তে হামলার একটি প্রতিক্রিয়া ছিল। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও শিশুহত্যাসহ অত্যধিক  মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত  মায়ানমার কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত হয়েছে।

মায়ানমারে অজ্ঞাত বিদ্রোহীর দ্বারা বার্মা সীমান্ত পুলিশ পোস্টে হামলা অভিযোগ করে রোহিঙ্গাদের সাথে বহুদিন ধরে খারাপ আচরণ বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বিদ্যমান অংশগ্রহণকারী সামরিক শাসকদের হাতে বিস্তৃতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়, এবং গণহারে বাস্তুচ্যুত বলপূর্বক স্থানান্তর ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ গণহত্যার মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়।

রোহিঙ্গা জনগণের ওপর এই সামরিক অভিযান জাতিসংঘ (যা "মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ" হিসেবে চিহ্নিত), মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট, প্রতিবেশী বাংলাদেশ সরকার এবং মালয়েশিয়ার সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দা জানান। ( যেখানে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে গেছে)। মায়ানমার সরকার প্রধান, অং সান সু চি, বিশেষ করে তার নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতার জন্য এবং এই সামরিক অপব্যবহার প্রতিরোধে বলতে গেলে কোন কাজ না করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন।

রোহিঙ্গা জনগণদেরকে "পৃথিবীতে সবচেয়ে কম প্রয়োজন বোধ করা"এবং "সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের মধ্যে অন্যতম" বর্ণনা করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের মুক্তভাবে চলাফেরা এবং উচ্চশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।বার্মিজ জাতীয়তা আইন প্রণীত হওয়ার পর থেকে তাদের বার্মিজ নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তারা কোনও সরকারী অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারবে না এবং পূর্বে তাদের দুই সন্তানের বেশি না নেয়ার প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করতে হত, যদিও এই আইনটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। তারা রুটিনমাফিক জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিগৃহীত; সাধারণতঃ রোহিঙ্গা পুরুষদের সপ্তাহে এক দিন সামরিক ও সরকারি প্রকল্পে কাজ করতে হবে এবং এক রাতের জন্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে হবে। রোহিঙ্গারা মায়ানমারের অন্যত্র থেকে বৌদ্ধ বাসিন্দাদেরকে দেয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে আবাদি জমি হারিয়েছে।

এবার আমি আপনাদের বুঝার জন্য মায়ানমার রাষ্ট্রের ভৌগোলিক ও নাগরিক অবস্থানের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরছি,

মায়ানমার বার্মা নামেও পরিচিত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ, যার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশ ও ভারত এবং পূর্বদিকে চীন, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমানা দ্বারা পরিবেষ্টিত। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সম্প্রতি মায়ানমারে উত্থাপিত গণতন্ত্র, ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর, স্বাধীন নির্বাচন করার অনুমতি দেয়, যা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীঅং সান সু চিকে গৃহবন্দী থাকার পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে ।

মায়ানমার মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী (জনসংখ্যার ৮৮% -৯০%), ভিন্ন বিশ্বাসী কিছু সংখ্যালঘুসহ, সংখ্যালঘুদের মধ্যে মুসলমান ৪%, যাদের বেশিরভাগকেই ভোট দিতে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে (কামান জাতি ব্যতীত)। মায়ানমার তার সংখ্যাগরিষ্ঠ বমা জাতি (বা বর্মণ) (৬৮%) দ্বারা প্রভাবিত, যাদের অধিকাংশই বৌদ্ধ।

বেশ কয়েকটি জাতিগত গোষ্ঠী সরকার কর্তৃক বৈষম্য, অপব্যবহার এবং অবহেলার শিকার; পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের উপকূল, এটি মূলত বৌদ্ধ রাখাইন (৪%, প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ) এবং মুসলিম রোহিঙ্গা (২%, প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ) অধ্যুষিত, যারা সরকারের হাতে নিপীড়নের শিকার। জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধরা প্রায়ই রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্য করে, বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ও সহিংসতা সৃষ্টি করেছে।রোহিঙ্গারা তাদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি সহকারে একটি স্বতন্ত্র জাতি, তবে তারা রাখাইন রাজ্যের সাথে দীর্ঘ ঐতিহাসিক সম্পর্কের দাবিদার।

রোহিঙ্গারা নিজেদেরকে আরব ব্যবসায়ীদের বংশধর হিসেবে বর্ণনা করে, যারা বহু প্রজন্ম আগে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল।ইতিহাসের পণ্ডিতরা বলেন যে, তারা ১৫ শতাব্দী থেকে এই অঞ্চলে অবস্থান করছে।তবে, মায়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছে এবং তাদেরকে বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বর্ণনা করেছে।

বর্তমান সময়কার, মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর অত্যাচার ১৯৭০-এর দশক থেকে চলে আসছে। তখন থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়মিতভাবে সরকার ও জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের দ্বারা নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।মায়ানমারের অতীতের সামরিক শাসকদের দ্বারা প্রায়ই বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী শোষিত হয়েছে যা তাদের মাঝে চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা তৎকালীন সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে আসছে। এর ফলে অনেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে।২০০৫ সালে, জাতিসংঘের শরণার্থীদের জন্য হাই কমিশনার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সহায়তা দিয়েছিলেন, কিন্তু শরণার্থী শিবিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এই প্রচেষ্টাকে হুমকিতে ফেলেছে। ২০১৫-তে, ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ১,৪০,০০০ রোহিঙ্গা আইডিপি ক্যাম্পে অবস্থান করে।

অতি সাম্প্রতিক সহিংসতার আগে, ১৭ মার্চ ২০১৬-তে “এট্রোসিটিজ প্রিভেনশন রিপোর্টে”, মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি-

"রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যেদীর্ঘমেয়াদী ঐতিহাসিক উত্তেজনা সংমিশ্রন, সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাত, আর্থ-সামাজিক অবনয়ন এবং বার্মার সরকার দ্বারা রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয়েই দীর্ঘস্থায়ী প্রান্তিককরণ, রাখাইন রাজ্যের অবস্থা গুরুতর করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দারিদ্র্যতার হার সর্বোচ্চ (৭৮ শতাংশ) এবং দেশটির সবথেকে দরিদ্র রাজ্য। একদিকে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা বিনিয়োগের অভাবের ফলে জীর্ণশীর্ণ অবকাঠামো এবং নিকৃষ্ট সামাজিক সেবায় পরিণত করেছে, অপরদিকে আইনশৃঙ্খলার অযোগ্যতাগুলি নিরাপত্তাহীনতার দিকে ধাবিত করছে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিশেষ করে বার্মার সরকারের নির্যাতন, বেআইনী গ্রেপ্তার ও আটক, চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা, ধর্মীয় অনুশীলনের ওপর ততা ধর্ম পালনে নিষেধাজ্ঞা, কর্মসংস্থান এবং বৈষম্যমূলক সামাজিক সেবা সহ সহিংসতার মুখোমুখি হয়। ২০১২ সালে, অন্তর্বর্তীকালীন দ্বন্দ্বের ফলে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা মারা যায় এবং ১,৪০,০০০ জন লোক বাস্তুচ্যুত হয়। ২০১৩-২০১৫ জুড়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে"

এখন আমি পাঠকদের যেন বুঝতে সহজ হয়, তাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক আগমন ও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকের সাথে মিশে যাওয়া এবং নিজ দেশ মায়ানমার এর সাথে বেঈমানীর কিছু তথ্য ও তাদের ইতিহাসের  ধারাবাহিকতার চিত্র তুলে ধরছি-
১৫৫৪ সালের আরাকানের মুদ্রা যা বৃহত্তর বাংলায় ব্যবহৃত হত।
অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলিমদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিকট  মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।

ম্রক-ইউ রাজ্যের সম্রাট নারামেখলার (১৪৩০-১৪৩৪) শাসনকালে বাঙালিদের আরাকানে বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত থাকার পরে সম্রাট বাংলার সুলতানের সামরিক সহায়তায় পুনরায় আরাকানের সিংহাসনে আরোহন করতে সক্ষম হন। যে সব বাঙালি সম্রাটের সাথে এসেছিল তারা আরাকানে বসবাস করতে শুরু করে। সম্রাট নারামেখলা বাংলার সুলতানের দেওয়া কিছু অঞ্চল ও আরাকানের ওপর সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন। সম্রাট নারামেখলা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বাংলার প্রতি কৃ্তজ্ঞতা স্বরূপ আরাকানে বাংলার ইসলামি স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন। পরবর্তীতে নারামেখলা নতুন মুদ্রা চালু করেন যার একপাশে ছিল বর্মি বর্ণ এবং অপরপাশে ছিল ফার্সি বর্ণ। বাংলার প্রতি আরাকানের কৃ্তজ্ঞতা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। ১৪৩৩ সালে সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহের মৃত্যু হলে সম্রাট নারামেখলার উত্তরাধিকারীরা ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেন। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। বাংলার সুলতানদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও আরাকানের রাজাগণ মুসলিম রীতিনীতি বজায় রেখে চলেন। বৌদ্ধ রাজাগণ নিজেদেরকে বাংলার সুলতানদের সাথে তুলনা করতেন এবং মুঘলদের মতোই জীবন যাপন করতেন। তাঁরা মুসলিমদেরকেও রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতেন। ১৭ শতকের দিকে আরাকানে বাঙালি মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা আরাকানের বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে কাজ করতো। যেহেতু রাজাগণ বৌদ্ধ হওয়ার পরেও বাংলার সুলতানদের রীতিনীতি অনুযায়ীই রাজ্য পরিচালনা করতো, তাই আরাকানের রাজদরবারে বাংলা, ফার্সি এবং আরবি ভাষার হস্তলিপিকরদের মধ্যে অনেকেই ছিল বাঙালি। কামেইন বা কামান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যারা মিয়ানমার সরকারের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্ত্বার মর্যাদা পেয়েছে তারা আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠীরই একটা অংশ ছিল।

১৭৮৫ সালে বর্মিরা আরাকান দখল করে। এর পরে ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বর্মিদের গ্রেপ্তার এড়াতে এবং আশ্রয়ের নিমিত্তে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। বার্মার শাসকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে তখন যেন এটি ছিল একটি মৃত্যুপুরী। ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত "বার্মা সাম্রাজ্য"তে ব্রিটিশ ফ্রাঞ্চিজ বুচানন-হ্যামিল্টন উল্লেখ করেন, "মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) - এর অনুসারীরা", যারা অনেকদিন ধরে আরাকানে বাস করছে, তাদেরকে "রুইঙ্গা" (Rooinga) জাতি কখনোই নিজেদেরকে "আরাকানের স্থানীয় বাসিন্দা" বা "আরাকানের মূলনিবাসী" (Native of Arakan) উল্লেখ করে নি।

ইংরেজ শাসন আমলে কৃষিকাজের জন্য আরাকানের কম জন-অধ্যুষিত এবং উর্বর উপত্যকায় আশপাশের এলাকা থেকে বাঙালি অধিবাসীদের অভিবাসন করার নীতি গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। আরাকান ও বাংলার মাঝে কোন আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছিল না এবং এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোন বিধিনিষেধও ছিল না। তাছাড়া ব্রিটিশরা আরাকান দখলের পূর্বেকার সময় কালাদান নদীর উত্তর তীর পর্যন্ত চট্টগ্রামের দক্ষিণ সীমানা ছিল, যা বার্মার সাথে যুক্ত ছিল বলে কোন ঐতিহাসিক দলিলের অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয় নি। উনবিংশ শতকে হাজার হাজার বাঙালি কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানে গিয়ে বসতি গড়েছিল। এছাড়াও হাজার হাজার রাখাইন আরাকান থেকে বাংলায় চলে এসেছিল।

১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের করা এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, আরাকানে তখন ৫৮,২৫৫ জন মুসলিম ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৮,৬৪৭ জন হয়। অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বাংলার সস্তা শ্রম যা আরাকানের ধান ক্ষেতের কাজে লাগত। বাংলার এই অধিবাসীরা (বেশিরভাগই ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলের) মূলত আরাকানের দক্ষিণেই অভিবাসিত হয়েছিল। এটা নিশ্চিত যে, ভারতের এই অভিবাসন প্রক্রিয়া ছিল পুরো অঞ্চল জুড়ে, শুধু আরাকানেই নয়। ঐতিহাসিক থান্ট মিন্ট-ইউ লিখেছেন: "বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বার্মায় আসা ভারতীয়দের সংখ্যা কোনভাবেই আড়াই লক্ষের কম নয়। এই সংখ্যা ১৯২৭ সাল পর্যন্ত বাড়তেই থাকে এবং অভিবাসীদের সংখ্যা হয় ৪৮০,০০০ জন, রেঙ্গুননিউ ইয়র্ককেও অতিক্রম করে বিশ্বের বড় অভিবাসন বন্দর হিসেবে। মোট অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.৩ কোটি (১৩ মিলিয়ন)।" তখন বার্মার রেঙ্গুন, আকিয়াব, বেসিন, প্যাথিন এবং মৌমেইনের মত অধিকাংশ বড় শহরগুলোতে ভারতীয় অভিবাসীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশ শাসনে বর্মিরা অসহায়ত্ব বোধ করত এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে তারা অভিবাসীদের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত।

অভিবাসনের ফলে সংঘাত মূলত আরাকানেই ছিল সবচেয়ে প্রকট। ১৯৩৯ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার অবসানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন জেমস ইস্টার এবং তিন তুতের দ্বারা একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে। কমিশন অনুসন্ধান শেষে সীমান্ত বন্ধ করার সুপারিশ করে। এর মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরে ব্রিটিশরা আরাকান ছেড়ে চলে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ বার্মা আক্রমণ করে। ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ব্রিটিশপন্থীদের সাথে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়। জাপানিদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্থী অস্ত্রধারী মুসলিমদের দল বাফার জোন সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গারা যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল এবং জাপানি শক্তির বিরোধিতা করেছিল, পর্যবেক্ষণে সাহায্য করেছিল মিত্রশক্তিকে।

জাপানিরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। এই সময়ে প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে গিয়েছিল।

জাপানি এবং বর্মিদের দ্বারা বারংবার গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসে।

পরে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির সময় রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহের সাথে একাধিক বৈঠক করে পাকিস্তানের সাথে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। তাদের এই কাজটা আরাকানের অন্য জাতিগোষ্ঠিরা মেনে নিতে পারেননি। তাদের কপালে “বেঈমান” তকমা লেগে যায়। এদিকে জিন্নাহ রোহিঙ্গাদের প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানান। তখন তারা নিজেরাই রোহিঙ্গা মুসলিম পার্টি গঠন করে আরাকান স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার বার্মায় ক্ষমতা পেলে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ১৯৭৮ আর ১৯৯২ সালে দুইবার তাদের উপর সামরিক অভিযান চালানো হলে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে বার্মা শাসন করছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। আর এর ফলেই তারা রোহিঙ্গা, চীনা জনগোষ্ঠী যেমন - কোকাং, পানথাইদের(চীনা হুই মুসলিম) মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে ব্যপকভাবে নির্যাতন করে থাকে। কিছু নব্য গণতন্ত্রপন্থী নেতা যারা বার্মার প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে এসেছেন তারাও রোহিঙ্গাদের বার্মার জনগণ হিসেবে স্বীকার করেন না।

বার্মার সরকার রোহিঙ্গা ও চীনা জনগোষ্ঠীর মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার উসকানি দিয়ে থাকে এবং এ কাজ তারা অতি সফলতার সাথেই করে যাচ্ছে।

এছাড়াও রাখাইনে ২০১২ সালের দাঙ্গা হচ্ছে মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম ও বোদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের ঘটনাপ্রবাহ। দাঙ্গা শুরু হয় জাতিগত কোন্দলকে কেন্দ্র করে এবং উভয় পক্ষই এতে জড়িত হয়ে পরে। আর এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে।

বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি তথ্য মতে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা নাগরিক অবস্থা করছে। যার বেশিরভাগ নারী ও শিশু রয়েছে, আর নারীদের অধিকাংশই মায়নমারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে এদেশে এসেছে। প্রায় ২০ হাজার শিশু পিতা-মাতাহীন এতিম এবং বেসরকারি তথ্য মতে গত ২ বছরে আরো ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিশাল একটা অংশ শারীরিক এবং মানসিকভাবে  অসুস্থ।  এই বিশাল জনসংখ্যার অবস্থান একটি নিদিষ্ট এলাকায় স্থানীয়দের সাথে হওয়াতে সামাজিক, প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক ভাবে ঐ এলাকাটিতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গারা অধিকাংশ অশিক্ষিত, অসচেতন ও অভাবগ্রস্থ হওয়াতে তাদের নিজেদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, হানাহানি, মাদক চোরাচালান ও নারী পাচার এবং দেহব্যবসার মত কাজ দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রার্থকের কারনে কিছু কিছু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।  রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা বাহিরে অবাদে চলাচল করছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।  এরমধ্যে অনেক বার রোহিঙ্গা ও স্থানীয় নাগরিকদের মাঝে সংঘর্ষের ঘঠনাও ঘঠেছে।  ক্যাম্প এলাকায় স্থানীয় নাগরিকদের তুলনার রোহিঙ্গার সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় স্থানীয়রা এখন রোহিঙ্গাদের কাছে অনেকটা জিম্মি হওয়ার মত। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের দিয়ে কিছু দেশি ও বিদেশি মহল উস্কানিমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া চেষ্টা করছে। ঐ এলাকাটি আন্তর্জাতিক ও দেশিয় মাদক চোরাচালানের লিংক রোড হওয়াতে রোহিঙ্গাদের একটা অংশ ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। অতিবৃষ্টি প্রবণ ও সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা হওয়ার কারণে বর্ষায় মৌসুমে ঐ এলাকাটিতে ব্যাপক মানবিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। পাহাড়ি বনভূমি হওয়ায় গরমেও ব্যাপক হারে বিশুদ্ধ পানির সংকট এবং ডায়রিয়া সহ নানান রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও এইচআইভি আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ব্যাপক, এবং এর সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।  ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অসচেতনতার কারণে এদের জন্মনিরোধক ঔষধ ব্যবহার করার হার একেবারেই কম, যার ফলস্বরূপ গত দুই বছরে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। মোট কথায় বলতে গেলে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এলাকা রোহিঙ্গা অভিবাসীদের চাপে মানবিক বিপর্যয় চরম আকার নিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই আইন শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে।  স্থানীয় নাগরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে রোহিঙ্গাদের সংঘাত ও সংঘর্ষ একটি নিয়মিত ঘটনা। আবার রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হয়েছে, এরা বিভিন্ন নামে বেনামে গ্রুপিং করছে।বর্তমানে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও মানব পাচারের মত অপরাধ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিশেষে বলবো, আরাকানের ভূমি ইতিহাসের সাথে রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং ঐ ভূমিটির নাগরিক দাবিদার হওয়ার জন্য রোহিঙ্গারা অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা (মায়ানমার নাগরিক) আশ্রয় দিয়ে পৃথিবীতে এক বিরল মানবিকতার ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যদিও একটি উন্নয়নশীল অধিক জনসংখ্যার দেশে হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটা একটা ঝুকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিলো। তারপরও এই আশ্রয় বাঙালির মানবিকতার ইতিহাসকে বিশ্বের বুকে নজিরবিহীন সম্মানের আসনে নিয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা  কয়েকশত বছর ধরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গিয়ে আরাকানে
বসবাস করে আসছে।  গত কয়েক দশকে ধরে তাদের উপর মায়ানমার সরকার ও উগ্র বৌদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠির নির্যাতন  চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং বাংলাদেশ ও মায়ানমার সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে। এই সমস্যাকে আন্তর্জাতিক মহল ও মায়ানমার সরকার গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে এবং যতদ্রুত সময়ে সম্ভব এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নাগরিক ও মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে আরাকানে তাদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করে মায়ানমার ফিরিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে এই মানবিক ও জাতিগত সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরে তাদের ফিরিয়ে নিতে মায়ানমার সরকারকে বাধ্য  করা এবং এই মহূর্তে রোহিঙ্গা নাগরিকদেরকে আমাদের মূল ভূখণ্ডের বাহিরে আলাদা একটি নিদিষ্ট এলাকা রাখা।  তাদের কারণে যেন এদেশের নাগরিকদের কোন অসুবিধা নাহয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া।

লেখকঃ
মুহাম্মাদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স)
এমএসএস (অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
০১৭১২-৬৪৩১৭২

No comments:

Post a Comment