Wednesday, May 15, 2019

ধর্মীয় সংস্কার ও ফরায়েজি আন্দোলনঃঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

ধর্মীয় সংস্কার ও ফরায়েজি আন্দোলনঃ
(মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

হাজী শরীয়তুল্লাহর জন্ম হয়েছিল ১৭৮১ সালে বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলায় চর শামাইল (বাহাদুরপুর) গ্রামের এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে। আর মৃত্যুবরণ করেন ১৮৪০ সালে। তিনি মক্কা শরীফে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে হজ পালনের গমন করেন, এবং মক্কায় প্রায় ২০ বছর অবস্থান করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে বাংলায় ফিরে আসেন।
তিনি একজন আরবি ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। এছাড়াও ধর্মীয় সংস্কারক, নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী নেতা এবং ভারতবর্ষে সংঘটিত ফরায়জি আন্দোলন তারই নেতৃত্বে হয়েছিল। তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, ছিলেন কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনার প্রধান সংগঠক ও নেতা।

দেশে ফিরে তিনি আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের আদলে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। নীলকর ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তার প্রবর্তিত ধর্মমত ছিল আধুনিক ও মানবতাবাদী। মুসলিম ধর্মের উৎপীড়নমূলক নিয়ম রদ করে ভন্ড মোল্লা মৌলবীদের হাত থেকে তার শিষ্যদের রক্ষা করেন। একারনে রক্ষণশীল ধনী মুসলমানেরা তাকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার অসংখ্য কৃষক তার শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিল। তার ছেলে দুদু মিয়াও একজন ঐতিহাসিক যোদ্ধা এবং ফরায়েজী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এদেশ থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানোতে ভূমিকা রেখেছেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ'র নামানুসারে বাংলাদেশের শরিয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া তার নামে মাদারিপুরের শিবচরে আড়িয়াল নদীর উপরে নির্মিত সেতুটির নাম করণ করা হয়েছে-
"হাজী শরীয়তুল্লাহ সেতু"

ফরায়েজী আন্দোলন  ঊনিশ শতকে বাংলায় গড়ে ওঠা একটি সংস্কার আন্দোলন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ধর্ম সংস্কার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনে আর্থ-সামাজিক সংস্কারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফরায়েজী শব্দটি ‘ফরজ’ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কাজেই ফরায়েজী বলতে তাদেরকেই বোঝায় যাদের লক্ষ্য হচ্ছে অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ কার্যকর করা।
এ আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি অবশ্য শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, অবশ্য পালনীয়ই হোক বা ঐচ্ছিকই হোক, কুরআন ও সুন্নার নির্দেশিত সকল ধর্মীয় কর্তব্যই এর অন্তর্ভুক্ত। শরীয়তউল্লাহ হজ্ব পালনের জন্য মক্কায় যান এবং সেখানে  হানাফি শাস্ত্রজ্ঞ শেখ তাহির সোম্বলের নিকট ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। দেশে ফিরে তিনি দেখতে পান যে, বাংলার মুসলমানদের একটি অংশ বহুবিধ স্থানীয় লোকাচার ও পর্ব-উৎসব পালনে উৎসাহী হয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার প্রতি চরম উদাসীন হয়ে উঠেছেন। সে কারণেই তিনি ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেন এবং কালক্রমে এ আন্দোলন সমগ্র পূর্ববঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

হাজী শরীয়তউল্লাহ বাংলায় ব্রিটিশ শাসনকে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করতেন। হানাফি আইনের অনুসরণে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বাংলায় বৈধভাবে নিযুক্ত একজন মুসলিম শাসকের অনুপস্থিতি মুসলমানদের জুমআর নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠানের সুযোগ হতে বঞ্চিত করেছে। এ মত ছিল ফরায়েজী আন্দোলনের একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য যা একে ওই সময়ের অপরাপর পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন থেকে আলাদা করে তুলেছে।

হাজী শরীয়তউল্লাহ মনে করতেন, আজ বাংলার মুসলিম সমাজ নিজেদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে উদাসীন ও অসচেতন। মুসলমান কৃষকদের আত্মসচেতন ও উজ্জীবিত করার কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি ছিলেন, একজন একনিষ্ঠ ধর্মপ্রচারক ও সহানুভূতিশীল কৃষক দরদী । ফরায়েজী আন্দোলন অসামান্য দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা, ফরিদপুর,বরিশাল,ময়মনসিংহ, কুমিল্লা,চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলাসমূহে এবং আসাম প্রদেশে বিস্তারলাভ করে। যেসব এলাকায় নব্য হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরগণ শক্তিশালী ছিল এবং কৃষকদের উপর অত্যাচার চালাত সেসকল এলাকায় এ আন্দোলন সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

কিন্তু সমকালীন বাঙালি সমাজে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ফরায়েজী আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলতে পারেনি। ভূস্বামী শ্রেণি এর স্বার্থ রক্ষার্থে ফরায়েজী ও রক্ষণশীল গোঁড়া মুসলমানদের মধ্যে বিরোধে হস্তক্ষেপ করে। ঢাকার জমিদারগণ পুলিশের সহায়তায় রামনগরে অবস্থিত প্রচারকেন্দ্র থেকে শরীয়তউল্লাহকে বহিষ্কার করেন। হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের সঙ্গে অবিরাম সংঘর্ষের ফলে আন্দোলনটি ক্রমান্বয়ে আর্থ-সামাজিক রূপে চুয়ান্ত সফল হয়নি।

উনিশ শতকে মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নব্য জমিদারগণ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয় এমন বহু অতিরিক্ত অবৈধ কর কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেয়। এমনকি, তারা মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে  কালীপুজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য কর আদায় করত। শরীয়তউল্লাহ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং জমিদারদের এসকল অবৈধ কর প্রদান না করার জন্য তার শিষ্যদের নির্দেশ দেন। জমিদার গণ ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরু জবাইয়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। গরু কোরবানি করা মুসলমানদের প্রচলিত ধর্মীয় প্রথা এবং মুসলমানদের খাদ্য হিসেবে অন্যান্য মাংসের তুলনায় গরুর মাংসের মূল্য কম বিধায় শরীয়তউল্লাহ এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার জন্য মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেন।

কলকাতার সংবাদপত্র এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনাকালে ফরায়েজীদের বিদ্রোহী ভাবাপন্ন দল হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচারাভিযান শুরু করে। ১৮৩৭ সালে জমিদারগণ শরীয়তউল্লাহকে তিতুমীর এর ন্যায় একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তারা ফরায়েজীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করে এবং এ কাজে তারা ইউরোপীয় নীলকরদের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করে। কিন্তু তাদের অভিযোগসমূহ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হওয়ায় কোন অভিযোগই আদালতে প্রমাণ করতে পারে নি। অবশ্য ফরিদপুরে শান্তিভঙ্গ ও গোলযোগ সৃষ্টির অভিযোগে ১৮৩৯ সালে শরীয়তউল্লাহ একাধিকবার পুলিশি হেফাজতে ছিলেন।

১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র মুহসীন উদ্দীন ওরফে দুদু মিয়াকে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা ঘোষণা করা হয়। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তো সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রণোদিত একটি জমিদার শ্রেণি গড়ে তোলে। প্রজাদের কাছ থেকে জোর করে যতটা সম্ভব অর্থ আদায় করা ছাড়া অপর কোন চিন্তাই তাদের ছিল না। তারা বহুসংখ্যক লাঠিয়াল পুষত এবং তাদের সাহায্যে প্রজাদের উপর নির্যাতন চালাত।

এ ব্যবস্থা জমিদারদের বস্ত্তত সামন্তাধিকার প্রদান করে এবং কৃষক শ্রেণিকে প্রায় ভূমিদাসে পরিণত করে। কলকাতার আদালত ছিল দরিদ্র কৃষকদের আওতার বাইরে। জমিদারদের যৌক্তিক পথে আনার জন্য শক্তি প্রয়োগ ছাড়া দুদু মিয়ার আর কোন উপায় ছিল না। তিনি কানাইপুরের শিকদার পরিবার ও ফরিদপুরের ঘোষদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এরূপ এক সংঘর্ষে মদন ঘোষ নিহত হন। এর ফলে ১১৭ জন ফরায়েজী আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন এবং তাদের মধ্যে ২২ জন দায়রা জজ কর্তৃক ৭ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন। দুদু মিয়া সহ অন্যান্যরা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।

দুদু মিয়ার এই প্রাথমিক বিজয় জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাদের কাছে তাঁর সম্মান অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ঘটনাপ্রবাহ ফরায়েজী আন্দোলনের প্রসারে আরও প্রেরণা যোগায়। এতদিন যেসব মুসলমান আন্দোলন থেকে দূরে ছিল শুধু তারাই যে এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তা নয়, জমিদারদের বিরুদ্ধে দুদু মিয়ার সাহায্য লাভের জন্য হিন্দু ও দেশীয় খ্রিস্টানগণও এ আন্দোলনে যোগ দেয়।

জমিদারদের প্ররোচনায় এন্ড্রু ডানলপ্ নামের একজন প্রভাবশালী নীলকর দুদু মিয়ার চরম শক্রতে পরিণত হয়। কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলাল নামের  এক মাড়োয়ারি হিন্দু পাঁচচরে ডানলপের নীলকুঠির গোমস্তা ছিলেন। ১৮৪৬ সালের অক্টোবর মাসে পাঁচচরের হিন্দু বাবুদের সঙ্গে মিলে আনুমানিক সাত-আটশ’ লোক নিয়ে কাঞ্জিলাল বাহাদুরপুরে দুদু মিয়ার বাড়ি আক্রমণ করেন। দুদু মিয়ার অভিযোগ মতে তারা সামনের দরজা ভেঙে ফেলে, চার জন পাহারাদারকে হত্যা করে এবং অন্যান্যদের মারাত্মকভাবে জখম করে নগদ অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ কেড়ে নেয়। ঘটনাটি পুলিশকে জানালে হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে শুধুমাত্র আহত ব্যক্তিদের বিচারার্থে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রেরণ করেন।

ডানলপের গোমস্তা কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলালের সঙ্গে এ সংঘর্ষের কারণে দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করে দায়রায় সোপর্দ করা হয়। দায়রা আদালত দুদু মিয়া ও তার ৪০ জন অনুসারীকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করে। কিন্ত প্রদত্ত গুরুদন্ড এ আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় রায়টি অনুমোদনের জন্য কলকাতায় সদর নিজামত আদালতে প্রেরণ করা হয়। সদর নিজামত আদালত ফরিয়াদির অভিযোগের বর্ণনা অংশত চরম অবাস্তব এবং অংশত একদম অবিশ্বাস্য বলে মনে করে। ফলে তারা সবাই খালাস পেয়ে যান। দুদু মিয়ার অনুসারিগণ একে নিপীড়িত কৃষককুলের জন্য এক মহাবিজয় বলে স্বাগত জানায়।

১৮৬২ সালে দুদু মিয়া মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার নাবালক পুত্র গিয়াসউদ্দীন হায়দার ও আবদুল গফুর ওরফে নয়া মিয়ার তত্ত্বাবধানের জন্য একটি অভিভাবক পরিষদ গঠন করেন। এ দুই পুত্র পরপর ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। পরিষদ ক্ষীয়মান আন্দোলনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। নয়া মিয়ার বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে এবং তার নেতৃত্বে আন্দোলন হারানো শক্তি কিছুটা ফিরে পায়। মাদারীপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক নবীনচন্দ্র সেন বিচক্ষণতার সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তিতে ফরায়েজী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তোলেন। ফরায়েজী নেতৃবৃন্দও তাদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করে।

১৮৮৪ সালে নয়া মিয়ার মৃত্যুর পর দুদু মিয়ার তৃতীয় ও কনিষ্ঠতম পুত্র সৈয়দউদ্দীন আহমদ ফরায়েজীদের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর সময়ে তাইয়ুনি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফরায়েজীদের সংঘর্ষ চরমে পৌঁছে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় বিতর্ক পূর্ববঙ্গে নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। সরকার সৈয়দউদ্দীনকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এর প্রশ্নে তিনি বিভাজনের পক্ষে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। কিন্তু ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

খান বাহাদুর সৈয়দউদ্দীনের পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র রশিদউদ্দীন আহমদ ওরফে বাদশা মিয়া ফরায়েজী নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর নেতৃত্বের প্রথমদিকে বাদশা মিয়া সরকারের প্রতি সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ তাকে ব্রিটিশ বিরোধী করে তোলে এবং তিনি খেলাফত ও অসহযোগী আন্দোলনে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি নারায়ণগঞ্জে ফরায়েজীদের এক সম্মেলন আহবান করে পাকিস্তানকে ‘দারুল ইসলাম’ বলে ঘোষণা করেন এবং তার অনুসারীদের জুমআ ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করেন।

ফরায়েজীগণ তাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মানুশীলনে কতিপয় স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যসহ হানাফি মযহাবের অনুসারী ছিল। ঐ বৈশিষ্ট্যগুলিকে মোটামুটি পাঁচটি ফরায়েযী মতবাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়:
১. তওবা অর্থাৎ আত্মার পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে অতীত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।
২. ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ কঠোরভাবে পালন করা। ৩. কুরআন নির্দেশিত তৌহিদ বা একেশ্বরবাদ।
৪. ভারতবর্ষ ‘দারুল হরব’ বিধায় এখানে জুমআ ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠান অত্যাবশ্যকীয় নয়।
৫. কুরআন ও সুন্নাহ বহির্ভূত সকল লোকাচার ও অনুষ্ঠানকে ‘বিদাত’ বলে পরিহার করা।
পীর ও ‘মুরিদ’ অভিধার পরিবর্তে ফরায়েজীদের নেতাকে ‘ওস্তাদ’ বা শিক্ষক এবং তার অনুসারীদের ‘শাগরিদ’ বা শিষ্য বলা। ফরায়েজী জামায়াতে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিকে ‘তওবার মুসলিম’ বা ‘মুমিন’ বলা।

ফরায়েজীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে দুদু মিয়ার দুটি লক্ষ্য ছিল: ১. হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার থেকে ফরায়েজী কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষা করা এবং ২. জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য তিনি এক স্বেচ্ছাসেবক লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন এবং তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি অর্জনের জন্য তিনি ফরায়েজীদের নেতৃত্বে সনাতন স্থানীয় সরকারব্যবস্থা (পঞ্চায়েত) পুনঃপ্রবর্তন করেন। প্রথমোক্তটি ‘সিয়াসতি’ বা রাজনৈতিক শাখা এবং পরেরটি ‘দ্বীনি’ বা ধর্মীয় শাখা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ দুটি শাখা একীভূত করে ‘খিলাফত’ ব্যবস্থার রূপ দেওয়া হয়।

ফরায়েজী খিলাফত পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল সকল ফরায়েজীকে দুদু মিয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের (খলিফা) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা। খলিফাদের এই পরম্পরায় সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ‘ওস্তাদ’ দুদু মিয়া। তিনি তিন পদমর্যাদার খলিফা নিয়োগ করেন: উপরস্থ খলিফা, তত্ত্বাবধায়ক খলিফা ও গাঁও খলিফা।

দুদু মিয়া ফরায়েজী বসতি এলাকাকে ৩০০ থেকে ৫০০ পরিবারের এক একটি ছোট এককে বিভক্ত করেন এবং প্রতি এককে একজন গাঁও বা ওয়ার্ড খলিফা নিযুক্ত করেন। অনুরূপ দশ বা তদোধিক একক নিয়ে একটি সার্কেল বা গির্দ গঠিত হতো। প্রতিটি সার্কেল বা গির্দে একজন করে তত্ত্বাবধায়ক খলিফা নিয়োজিত হতেন। তত্ত্বাবধায়ক খলিফাকে একজন পিয়ন ও একজন পেয়াদা বা পাহারাদার দেওয়া হতো। এই পিয়ন ও পেয়াদারা একদিকে তত্ত্বাবধায়ক খলিফার সঙ্গে গাঁও খলিফাদের এবং অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক খলিফা ও ওস্তাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত। ‘উপরস্থ খলিফা’গণ ছিলেন ওস্তাদের উপদেষ্টা এবং তারা ফরায়েজী আন্দোলনের প্রধান কার্যালয় বাহাদুরপুরে ওস্তাদের সঙ্গে অবস্থান করতেন।

গাঁও খলিফা একজন সমাজপতির ভূমিকা পালন করতেন যার দায়িত্ব ছিল ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তার, ধর্মীয় কর্তব্য পালনে লোককে উদ্বুদ্ধ করা, খানকাহও মসজিদ সংরক্ষণ, নৈতিকতা পর্যবেক্ষণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচারকার্য সম্পন্ন করা। কুরআন শিক্ষা এবং ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের লক্ষ্যে একটি মকতব পরিচালনাও তার দায়িত্ব ছিল। তত্ত্বাবধায়ক খলিফার প্রধান দায়িত্ব ছিল গাঁও খলিফাদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করা, তার অধীনস্থ গির্দের ফরায়েজীদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখা, ধর্মের মৌলনীতি প্রচার এবং সর্বোপরি গাঁও খলিফাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোন আপিল মামলার নিষ্পত্তি করা। এরূপ ক্ষেত্রে তিনি তার গির্দের খলিফাদের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদে বসে আপিল মামলার শুনানি গ্রহণ করতেন। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সকল বিষয়ে দুদু মিয়ার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত এবং ওস্তাদ হিসেবে তিনি চূড়ান্ত আপিল আদালত হিসেবে কাজ করতেন।

ফরায়েজী আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক দিক হলো নবসৃষ্ট জমিদারদের নিপীড়ন প্রতিরোধের জন্য জনগণের একটি সুসংগঠিত পদক্ষেপ। এতে জমিদার ও নীলকরদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষক সম্প্রদায়ের অসন্তোষের তীব্রতার প্রতিফলন ঘটেছে। এটি ছিল জনতার কাতার থেকে এক ধরনের সফল নেতৃত্ব গড়ে উঠার একটি উদাহরণ।

লেখকঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) এমএসএস (অর্থনীতি)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Post a Comment