Friday, May 17, 2019

দানবীর হাজী মুহাম্মাদ মহসীন একজন সমাজ সংস্কারকঃ (মুহাঃ মহসীনভূঁইয়া)

দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া

হাজি মুহাম্মদ মহসিন ১৭৩২ সালে পশ্চিম বঙ্গের হুগলিতে জন্মগ্রহণ করেন, তার বাবা হাজি ফয়জুল্লাহ ও মা জয়নাব খানম। ফয়জুল্লাহ ছিলেন একজন ধনী জায়গিরদার। তাঁর পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছিল সুদূর ইরানের পারস্যে। সেখান থেকে ভাগ্য অন্বেষণে এসেছিলেন ভারত বর্ষে। তারপর স্থায়ীভাবে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি শহরে বসবাস শুরু করেন। জয়নব খানম ফয়জুল্লাহর দ্বিতীয় স্ত্রী। জয়নবেরও পূর্বে বিয়ে হয়েছিল। মন্নুজান খানম নামে তার ঘরে সাবেক স্বামী আগা মোতাহারের একটি মেয়ে ছিল। আগা মোতাহার বিপুল সম্পদের মালিক ছিলেন। হুগলি, যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায় তার জায়গির ছিল। আগা মোতাহারের সম্পত্তি তার মেয়ে মন্নুজান উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছিলেন।
গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে মহসিন ও তার সৎ বোন মন্নুজান শিক্ষার্জন করেছেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাজধানী মুর্শিদাবাদে যান। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি দেশভ্রমণের সফরে বের হন। সফরকালে তিনি হজ পালন করেন এবং মক্কা, মদিনা, কুফা, কারবালাসহ ইরান, ইরাক, আরব, তুরস্ক এমন নানা স্থান সফর করেছেন।

১৮০৩ সালে মন্নুজানের মৃত্যুর মহসিন তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পদের মালিক হন। মহসিন খুব ধার্মিক ছিলেন এবং সহজসরল জীবনযাপন করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন চিরকুমার। তার বিপুল সম্পদ দান সদকায় ব্যয় করতেন। ১৭৬৯-৭০ সালের সরকারি দলিল অনুযায়ী তৎকালীন দুর্ভিক্ষের সময় তিনি অনেক লঙ্গরখানা স্থাপন করেন এবং সরকারি তহবিলে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন।১৮০৬ সালে তিনি মহসিন ফান্ড নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করে তাতে দুইজন মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করেন।ব্যয়নির্বাহের জন্য সম্পত্তিকে নয়ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে তিনটি ভাগ ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, চারটি ভাগ পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ড এবং দুইটি ভাগ মোতাওয়াল্লিদের পারিশ্রমিকের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
হাজি মুহাম্মদ মহসিন ১৮১২ সালে হুগলিতে ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলি ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।
দানশীলতার কারণে তিনি কিংবদন্তীতে পরিণত হন এবং বর্তমানেও দানের ক্ষেত্রে তুলনা অর্থে তার দৃষ্টান্ত ব্যবহার হয়ে থাকে। পাঠকদের জন্য এই মহান ব্যক্তির কর্মময় জীবনের বিস্তারিত তুলেধরা হলো-

দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনের অবদান বাংলার ইতিহাসে অনস্বীকার্য। তিনি শুধু দানবীরই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানুষের প্রতি মায়া-মমতার মূর্ত প্রতীক। মুসলমান জনগোষ্ঠীকে উচ্চ শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘মহসিন ফান্ড’ নামক সংস্থায় গঠন করে তাঁর সর্বস্ব দান করেছিলেন। দান ও মহানুভবতার জন্য তার অবদান মানব ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

হাজি মুহাম্মদ মহসিনের মা জয়নব খানম ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের খাজাঞ্চি আগা মোতাহারের দ্বিতীয় স্ত্রী। ভাগ্যের অন্বেষণে ভারতবর্ষে আসা আগা মোতাহার সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রীর ঘরে কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনি জয়নব খানমকে সন্তান লাভের আশায় বিবাহ করেন। দীর্ঘ দিন পর মোতাহারের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নিল কন্যা সন্তান মন্নুজান। আগা মোতাহার এক সময় তাঁর মেয়ের নামে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করেন। মন্নুজান ছোট থাকায় এ দানপত্র তিনি একটি মাদুলিতে ভরে তাঁর গলায় পরিয়ে দেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তা দেখার জন্য উপদেশ দেন।
আগা মোতাহারের মৃত্যুর পর মন্নুজান সবে মাত্র কৈশোরে পদার্পন করেছে। সে মাদুলি খুলে দেখেন আগা মোতাহার তার সমস্ত সম্পদ মেয়ের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। যা দেখে জয়নব খান মন্নুজানকে হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। পরে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আগ মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহকে। এ ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেন দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিন। তখন সৎ বোন মন্নুজানের বয়স ১৩ বছর। মন্নুজানও ভাই পেয়ে মহাখুশী। হাজি মুহাম্মদ মহসিনের লালন–পালন, দেখাশুনা ও বাল্য শিক্ষা মন্নুজানের তত্ত্বাবধানেই চলতে লাগলো।

স্থানীয় মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন হাজি মুহাম্মদ মহসিন। সেখানে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষা শিখতেন। অল্প বয়সে তাঁর মেধা ও মনের গভীরতার পরিচয় পেয়ে শিক্ষকগণ অবাক হয়ে যান। চারিদিকে তার অসাধারণ মেধার কথা ছড়িয়ে পড়ে। পরে মুর্শিদাবাদের নবাব তাঁর মেধা কথা জানতে পেরে তাঁকে ডেকে পাঠান উচ্চ সরকারি পদ গ্রহণ করার জন্য। ইতোমধ্যে তাঁর পিতা মারা যান।

এদিকে বড়বোন মন্নুজান যৌবনে পদার্পন করেন। হাজি মুহাম্মদ মহসিন শিক্ষাকালে মন্নুজান হুগলিতে একাকি বাড়িতে থাকতেন। একদিকে তাঁর অনেক সম্পদ অন্য দিকে যুবতী মেয়ে। তাই কিছু দুষ্ট লোক তাঁর পেছনে ষড়যন্ত্র করতে লাগলো। মন্নুজান ষড়যন্ত্রের কথা জেনে ভাই হাজি মুহাম্মদ মহসিনকে পত্র পাঠান। পত্র পেয়ে হাজি মুহাম্মদ মহসিন বোনকে রক্ষায় বাড়ি ফিরে আসেন। ভাই মহসিনকে তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন। এবং
বোনকে সুপাত্রস্থ করার জন্য মহসিন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে হুগলিতে নবাবের নিযুক্ত ফৌজদার সালাহউদ্দিনের সঙ্গে বোনের বিবাহ দিলেন। ধন–সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত হাজি মুহাম্মদ মহসিন বোনের বিয়ের পর দেশ ভ্রমণে বের হন।
সফরকালে পবিত্র হজ পালন করে  মক্কা,মদিনা, কুফা, কারবালাসহ ইরান, ইরাক,আরব, তুরস্ক এমন নানা স্থান সফর করে দীর্ঘ ২৭ বছর পর দেশে ফিরে আসেন। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। এদিকে নিঃসন্তান বোন মন্নুজান স্বামীকে হারিয়ে বিধবা। তিনিও বার্ধক্যে উপনীত। অন্যদিকে বিশাল সম্পদের মালিক আবার একাকি নিঃসঙ্গ। বোন মন্নুজান সম্পদের পেরেশানি থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ধ্যানে জীবন কাটাতে ছোট ভাইয়ের নামে তাঁর সমস্ত সম্পদ লিখে দেন। সম্পদ লিখে দেয়া কয়েক বছর পর ১৮০৩ সালে মন্নুজান ইন্তেকাল করেন। হাজি মুহাম্মদ মহসিন ছিলেন ধার্মিক, দয়ালু  এবং দানবীর, তিনি সহজ সরল জীবনযাপন করতে পছন্দ করতেন। ৭০ বছরের হাজি মহসিন এ বিপুল সম্পদ দান সদকায় ব্যয় করার মনস্থ করলেন এবং বিশাল সম্পদ মানবতার কল্যাণে ব্যয় করেন। দেশের সকল গরীব–দুঃখী ও দুঃস্থদের সেবায় তিনি নিজের সব সম্পদ বিলিয়ে দেন। ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘মহসিন ফান্ড’ নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করে তাঁর সমুদয় অর্থ এ ফাউন্ডেশনের জন্য দান করেন। এ ফান্ডের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য দু'জন মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করেন। শুধু মোতাওয়াল্লি নিয়োগই নয়, মহসিন ফান্ডের ব্যয় নির্বাহের জন্য দানকৃত সম্পত্তিকে নয়ভাগে ভাগ করেন।
তন্মধ্যে তিনভাগ সম্পদ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য। চারভাগ সম্পদ পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে খরচ করার জন্য এবং দুইভাগ সম্পদ মোতাওয়াল্লিদের পারিশ্রমিকের জন্য বরাদ্দ করেন। তাছাড়া তাঁর দানকৃত অর্থে অসংখ্য দারিদ্র্য ছাত্রের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়।
১৮০৬ সালে তিনি তাঁর প্রায় সমস্ত ভূ–সম্পত্তি একটি ওয়াকফ দলিলের মাধ্যমে দান করে যান। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম শুরু হয়। ১৮৩৫ সালে আদালতের মাধ্যমে আইনি ঝামেলা মিটিয়ে সরকার মহসিন ট্রাস্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৮৩৫ সালেই এই ট্রাস্টের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলী মহসিন কলেজ এবং এই কলেজের সাথে হাজী মুহসীনের অর্থে পূর্বে নির্মিত দুটি স্কুলকে মিলিয়ে দেয়া হয়। উল্লেখ্য এইটিই ভারতবর্ষের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার কলেজ যেখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যেকেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। এর আগে ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ ছিল শুধু ‘the sons of respectable Hindoos’ এর জন্য এবং ১৮১৮ ও ১৮২০ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ ও বিশপস কলেজ ছিল খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী,শরৎচন্দ্র টট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ভুবনবিশ্রুত বাঙ্গালিরা সবাই এই হুগলী মহসিন কলেজের ছাত্র ছিলেন। অবশ্য ১৮৩৫ সালে ইংরেজ সরকার এর নাম হুগলী মহসিন কলেজ রাখলেও কোন এক কারণে দিনে দিনে মানুষের বলায় ও লেখায় এর নামটি দাঁড়ায় শুধু হুগলী কলেজ। মুহসীন শব্দটি ঝরে পড়ে যায়। ১৮৬০ সালের পরে কোনো কাগজপত্রে কিংবা সাইনবোর্ডে আর মুহসীন নামটা দেখাই যায় না। ১৯৩৬ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় কলেজটি মূল নামে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সে দাবি অনুযায়ী সরকারিভাবে পুনরায় কলেজটির নাম হয় হুগলি মহসিন কলেজ।
মহসিন ট্রাস্ট তথা মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড এর সৃষ্টি শুধু হুগলি মহসিন কলেজ নয়। হুগলিতে একটি হাসপাতাল নিয়মিতভাবে এই অর্থে চলছে। মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের অধিকাংশ জমি ছিল যশোর ও খুলনায়। এই ট্রাস্ট এস্টেটের জমিতে অনেকগুলো দাতব্য হাসপাতাল, সরকারি অফিস, খুলনা–কলকাতা রেললাইন ছাড়াও গড়ে ওঠে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খুলনার দৌলতপুরের সরকারি ব্রজলাল কলেজের ৪২ একর জমির ৪০ একরই মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের জমি। ব্রজলাল কলেজের অনেক আগে ১৮৬৭ সালে মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড এর অর্থে দৌলতপুরে তৈরি হয় একটি এ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল। ১৯৩৯ সালে এর নামকরণ হয় দৌলতপুর মহসিন হাই ইংলিশ স্কুল। ১৮৮৬ সালে সরকারি অর্থে খুলনা জেলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কিছুদিনেই স্কুলটি অর্থাভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে সরকারি সেই স্কুলটির জন্যও সরকার মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেট থেকে অর্থ মঞ্জুর করেন। এছাড়াও মহসিনের সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেটের অর্থে খুলনার দৌলতপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় মহসিন বালিকা বিদ্যালয় ও মহসিন মহিলা কলেজ।

১৮৭৪ সালে মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ড এর অর্থে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে তিনটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার মাদ্রাসাটি এখন সরকারি কবি নজরুল কলেজ ও চট্টগ্রামের মাদ্রাসাটি এখন হাজি মহম্মদ মহসিন কলেজ। আর রাজশাহীরটি এখন রাজশাহী গভর্নমেন্ট মাদ্রাসা নামে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে ইসলামি শিক্ষা শাখায় আই এ সার্টিফিকেট প্রদানের প্রতিষ্ঠান রূপে চলছে।
নবাব আব্দুল লতিফ, নবাব খাজা আব্দুল গণি প্রমুখের আবেদন নিবেদনের ভিত্তিতে ১৮৭৩ সালে সরকার মহসিন এনডাওমেন্ট ফান্ডের অর্থে স্কলারশিপ মঞ্জুরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকার আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে-যশোর, রংপুর,পাবনা, ফরিদপুর, বাকরগঞ্জ, ময়মনসিংহ,নোয়াখালি ও সিলেট জেলার স্কুলগুলোতে মুসলিম ছাত্রদের দুই তৃতীয়াংশ বেতন ও একজন আরবি শিক্ষকের বেতন এই ফান্ড খেকে দেয়া হবে। ১৯৩১ সালে বেঙ্গল এডুকেশন কোড মহসিন ফান্ডের বৃত্তির পরিমাণ ও সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে দেয়।
ধন–সম্পদের প্রতি নির্লোভ বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিন ১৮১২ সালে ৭৯ মতান্তরে ৮০ বছর বয়সে হুগলির নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলির ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।
এ মহান দানবীর তাঁর অসামান্য দানের কারণে কিংবদন্তীতে পরিণত হন। তাঁর স্মরণে হুগলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি কলেজ। বাংলাদেশের ‘চট্টগ্রাম সরকারি হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজ’ প্রতিষ্ঠা হয় তাঁর ওয়াকফকৃত অর্থ থেকে প্রাপ্ত অনুদানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মহসিন হল’ এবং ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি ‘বিএনএস হাজি মহসিন’ও তাঁর স্মরণে নামকরণ করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যেকজন দানবীর মহামানবের নাম আসবে, তাদের মধ্যে বাংলার মহান দানবীর ও মুসলিম শিক্ষাজাগরনের অগ্রদূত হাজি মুহাম্মদ মহসীন অন্যতম একজন। তিনি ছিলেন, ব্যক্তিজীবনে ধর্মপরায়ন এবং সামাজিক জীবনে দানবীর ও শিক্ষানুরাগী। বাংলা তথা ভারত বর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থায় হাজি মুহাম্মদ মহসীনের অবদান অতুলনীয় ও অনস্বীকার্য।

লেখকঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) এমএসএস (অর্থনীতি)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।  mohsinbhuiyan1980@gmail.com
01712-643172

বিশ্ব নবীর বিদায় হজ্জের ভাষণঃ (মুহাম্মাদ মহসীনভূঁইয়া)

বিশ্ব নবীর বিদায় হজ্জের ভাষণঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

নবী মুহাম্মদ (সঃ) আরাফাত ময়দানে ১০ যিলহজ্জ তারিখ কাসওয়া উটনীর পিঠে আসন গ্রহণ করেন, সে সময় প্রায় এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার সাহাবী তাঁর চারদিকে সমবেত ছিল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে মানবতার মহান মানব, হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সঃ) বলেন-
হে লোক সকল,  আমার কথা শোনো, আমি জানিনা, এবারের পর আমি তোমাদের সাথে এই জায়গায় আর মিলিত হতে পারবো কিনা।
তোমাদের রক্ত ও ধন-সম্পদ পরস্পরের জন্য আজকের দিন, বর্তমান মাস এবং এই শহরের মতই নিষিদ্ধ। শোনো মানুষ সকল, জাহেলিয়াত যুগের সবকিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের খুনও খতম করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে রক্ত আমি শেষ করেছি তা হচ্ছে, রবিয়া ইবনে হারেসের পুত্রের রক্ত। জাহেলী যুগের সুদ খতম করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে সুদ আমি খতম করেছি তা হলো, আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেবের সুদ, এখন থেকে সুদ শেষ করে দেওয়া হলো। আর নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, তোমারা তাদের আল্লাহর আমানতের সাথে গ্রহণ করেছো, আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে হালাল করেছো। তাদের উপর তোমাদের অধিকার,  তারা তোমাদের বিচানায় এমন কাউকে আসতে দিবেনা যাদের তোমরা পছন্দ করোনা। তোমাদের উপর তাদের অধিকার, তোমরা তাদের ভালো পানাহার ও পোশাক দিবে।
তোমাদের কাছে আমি এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা ধারণ করে থাকো তবে কখনও পথভ্রষ্ট হবেনা "তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব"।
মনে রেখো আমার পর কোন নবী নেই, তোমাদের পর কোন উম্মত নেই। আল্লাহর ইবাদত করবে, নামায আদায় করবে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, আনন্দের সাথে নিজ সম্পদের যাকাত দিবে, আল্লাহর ঘরে হজ্জ করবে, নিজ শাসকদের আনুগত্য করবে, যদি এরুপ করো, তবে আল্লাহর জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তোমাদেরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা কি বলবে ?
লক্ষ সাহাবী সমস্বরে বললেন, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি,  আপনি তাবলীগ করেছেন, পয়গাম পৌছে দিয়েছেন, কল্যাণ কামনার হক আদায় করেছেন। এ কথা শুনে বিশ্ব নবী মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) নিজের শাহাদাত আঙুল আকাশের দিকে তুলে লোকদের দিকে ঝুঁকে তিনবার বলেন, হে আমার রব, তুমি সাক্ষী থেকে।
তাঁর কথাগুলো হযরত রবিয়া ইবনে উমাইয়া ইবনে খালাফ উচ্চকণ্ঠে উপস্থিত সবার কাছে পৌছে দিচ্ছিলেন।  আর আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর সেদিনের সাথীরা অঝোরে কান্না করছিলো। হযরত ওমর (রাঃ) কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, পূর্ণাঙ্গতার পরতো অপূর্ণাঙ্গতাই থেকে যায়।
ভাষণ শেষ করার পর আল্লাহ তায়ালা কুরআনের আয়াত নাযিল করেন- "আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাংগ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পর্ণ করলাম, ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম"।
(সুরা মায়েদা, আয়াত-০৩)

লেখকঃ
মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স)
এমএসএস (অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Thursday, May 16, 2019

কাগমারী সম্মেলন ও মাওলানা ভাসানীঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

কাগমারী সম্মেলন ও মাওলানা ভাসানীঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় সম্মেলন, পরবর্তীতে পাকিস্তানের 
বিভক্তি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে বিশেষ ইঙ্গিতবহ ভূমিকা রেখেছিল এই সম্মেলন। ১৯৫৭ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেলার কাগমারী নামক স্থানে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ৮ই ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। উক্ত সম্মেলনে ভাসানী পাকিস্তানী শাসকদের হুশিয়ার করে বলেন, যদি পূর্ব পাকিস্তানে শোষণ অব্যাহত থাকে তবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে “আসসালামু আলাইকুম ” জানাতে বাধ্য হবেন এবং তিনি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরোধিতা করে বলেন, এই চুক্তি জনগন মানেনা, মানতে পারেনা। কাগমারী সম্মেলনে প্রদত্ব বক্তব্যে মওলানা ভাসানী শেষ পর্যায়ে রেগে উঠে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কে লক্ষ্য করে বলে ছিলেন 'শহীদ, তুমি আজ আমাকে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সমর্থন করতে বলছো। তুমি যদি আমাকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো, আমি বলবো, 'না'! তুমি যদি আমাকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো আমি বলবো 'না'! 'না'! তুমি যদি আমাকে আমার কবরে গিয়েও জিজ্ঞাস করো সেখান থেকে আমি চিৎকার করে বলবো 'না' 'না'। 
এই সভায় মওলানা ভাসানী তাঁর বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে। এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সাময়িক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহ্‌রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে, ১৮ই মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে মাওলানা ভাসানী পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫শে জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর পর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৭-র ৭ই অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ই অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকার কারাগারে ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।

লেখকঃ
মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) 
এমএসএস (অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লাহ আমাদের চেতনার অনুপ্রেরণাঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লাহ আমাদের স্বাধীনতার অনুপ্রেরণাঃ  (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

শহীদ তিতুমীর, যাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী (জন্ম ২৭শে জানুয়ারী ১৭৮২, মৃত্যু ১৯শে নভেম্বর,১৮৩১) তার পিতার নাম সৈয়দ মীর হাসান আলী ও মাতার নাম আবিদা রুকাইয়া খাতুন। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ও কৃষক প্রজার নেতা। ওয়াহাবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এই মহান বিপ্লবী । জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরূদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও বাঁশের কেল্লার নির্মাণের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় এই বাঁশের কেল্লাতেই ১৯ নভেম্বর ১৮৩১ সালে ৪৯ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান এবং সেখানে স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে (১৮২৭) তিতুমীর তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে 'তাহ্‌বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত 'দাঁড়ির খাজনা' এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। আগেই তিতুমীর পালোয়ান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন।
তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় পাঁচ হাজারে গিয়ে পৌঁছায় এবং তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়।
১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসাতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেল বাড়িয়া গ্রামে বাঁশ ও কাদা দিয়ে তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন।

তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। ঐ বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন, "ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।"১৪ নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের আক্রমণ করে। তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। ১৪শে নভেম্বর তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তাঁর বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
অনেক ঐতিহাসিক তিতুমীরের লড়াইকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় আখ্যা দেন কারণ মূলত হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতু যুদ্ধঘোষণা করেছিলেন। একথা সত্য তিতুমীর প্রজাদের একজোট করেছিলেন ধর্ম এবং জেহাদের ডাক দিয়েছেন। অত্যাচারী হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে আক্রমন, দেবনাথ রায় হত্যা, গো হত্যা ইত্যাদির উদাহরণ হিসেবে টানা যায়। অপরপক্ষে অমলেন্দু দে'র ভাষায় তিতুমীরের লক্ষ্য ও পথ ছিল ইসলামে পূর্ন বিশ্বাস এবং হিন্দু কৃষকদিগকে সাথে নিয়ে ইংরেজ মদতপুষ্ট জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা। তিতুমীরের আক্রমের লক্ষ্যবস্তু হিন্দুদের পাশাপাশি ধনী মুসলমানও ছিল। তার বক্তৃতা শোনার জন্যে দলে দলে হিন্দু মুসলিম কৃষক জমা হতো। তিতুমীরের এই সংগ্রাম ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ যার অভিমুখ ছিল অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবরা। শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লার আন্দোলন ছিল,এক কথায় ভারতবর্ষে ইংরেজ, জমিদার ও হিন্দু মহাজনদের অত্যাচারের বিরোদ্ধে কৃষক জনতার স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলন। যে ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ এ আমরা স্বাধীনতার প্রথম সোফান অর্জন করেছি।

মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস(অনার্স)এমএসএস(অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Wednesday, May 15, 2019

ধর্মীয় সংস্কার ও ফরায়েজি আন্দোলনঃঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

ধর্মীয় সংস্কার ও ফরায়েজি আন্দোলনঃ
(মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

হাজী শরীয়তুল্লাহর জন্ম হয়েছিল ১৭৮১ সালে বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলায় চর শামাইল (বাহাদুরপুর) গ্রামের এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে। আর মৃত্যুবরণ করেন ১৮৪০ সালে। তিনি মক্কা শরীফে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে হজ পালনের গমন করেন, এবং মক্কায় প্রায় ২০ বছর অবস্থান করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে বাংলায় ফিরে আসেন।
তিনি একজন আরবি ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। এছাড়াও ধর্মীয় সংস্কারক, নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী নেতা এবং ভারতবর্ষে সংঘটিত ফরায়জি আন্দোলন তারই নেতৃত্বে হয়েছিল। তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, ছিলেন কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনার প্রধান সংগঠক ও নেতা।

দেশে ফিরে তিনি আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের আদলে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। নীলকর ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তার প্রবর্তিত ধর্মমত ছিল আধুনিক ও মানবতাবাদী। মুসলিম ধর্মের উৎপীড়নমূলক নিয়ম রদ করে ভন্ড মোল্লা মৌলবীদের হাত থেকে তার শিষ্যদের রক্ষা করেন। একারনে রক্ষণশীল ধনী মুসলমানেরা তাকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার অসংখ্য কৃষক তার শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিল। তার ছেলে দুদু মিয়াও একজন ঐতিহাসিক যোদ্ধা এবং ফরায়েজী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এদেশ থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানোতে ভূমিকা রেখেছেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ'র নামানুসারে বাংলাদেশের শরিয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া তার নামে মাদারিপুরের শিবচরে আড়িয়াল নদীর উপরে নির্মিত সেতুটির নাম করণ করা হয়েছে-
"হাজী শরীয়তুল্লাহ সেতু"

ফরায়েজী আন্দোলন  ঊনিশ শতকে বাংলায় গড়ে ওঠা একটি সংস্কার আন্দোলন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ধর্ম সংস্কার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনে আর্থ-সামাজিক সংস্কারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফরায়েজী শব্দটি ‘ফরজ’ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কাজেই ফরায়েজী বলতে তাদেরকেই বোঝায় যাদের লক্ষ্য হচ্ছে অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ কার্যকর করা।
এ আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি অবশ্য শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, অবশ্য পালনীয়ই হোক বা ঐচ্ছিকই হোক, কুরআন ও সুন্নার নির্দেশিত সকল ধর্মীয় কর্তব্যই এর অন্তর্ভুক্ত। শরীয়তউল্লাহ হজ্ব পালনের জন্য মক্কায় যান এবং সেখানে  হানাফি শাস্ত্রজ্ঞ শেখ তাহির সোম্বলের নিকট ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। দেশে ফিরে তিনি দেখতে পান যে, বাংলার মুসলমানদের একটি অংশ বহুবিধ স্থানীয় লোকাচার ও পর্ব-উৎসব পালনে উৎসাহী হয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার প্রতি চরম উদাসীন হয়ে উঠেছেন। সে কারণেই তিনি ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেন এবং কালক্রমে এ আন্দোলন সমগ্র পূর্ববঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

হাজী শরীয়তউল্লাহ বাংলায় ব্রিটিশ শাসনকে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করতেন। হানাফি আইনের অনুসরণে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বাংলায় বৈধভাবে নিযুক্ত একজন মুসলিম শাসকের অনুপস্থিতি মুসলমানদের জুমআর নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠানের সুযোগ হতে বঞ্চিত করেছে। এ মত ছিল ফরায়েজী আন্দোলনের একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য যা একে ওই সময়ের অপরাপর পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন থেকে আলাদা করে তুলেছে।

হাজী শরীয়তউল্লাহ মনে করতেন, আজ বাংলার মুসলিম সমাজ নিজেদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে উদাসীন ও অসচেতন। মুসলমান কৃষকদের আত্মসচেতন ও উজ্জীবিত করার কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি ছিলেন, একজন একনিষ্ঠ ধর্মপ্রচারক ও সহানুভূতিশীল কৃষক দরদী । ফরায়েজী আন্দোলন অসামান্য দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা, ফরিদপুর,বরিশাল,ময়মনসিংহ, কুমিল্লা,চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলাসমূহে এবং আসাম প্রদেশে বিস্তারলাভ করে। যেসব এলাকায় নব্য হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরগণ শক্তিশালী ছিল এবং কৃষকদের উপর অত্যাচার চালাত সেসকল এলাকায় এ আন্দোলন সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

কিন্তু সমকালীন বাঙালি সমাজে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ফরায়েজী আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলতে পারেনি। ভূস্বামী শ্রেণি এর স্বার্থ রক্ষার্থে ফরায়েজী ও রক্ষণশীল গোঁড়া মুসলমানদের মধ্যে বিরোধে হস্তক্ষেপ করে। ঢাকার জমিদারগণ পুলিশের সহায়তায় রামনগরে অবস্থিত প্রচারকেন্দ্র থেকে শরীয়তউল্লাহকে বহিষ্কার করেন। হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের সঙ্গে অবিরাম সংঘর্ষের ফলে আন্দোলনটি ক্রমান্বয়ে আর্থ-সামাজিক রূপে চুয়ান্ত সফল হয়নি।

উনিশ শতকে মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নব্য জমিদারগণ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয় এমন বহু অতিরিক্ত অবৈধ কর কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেয়। এমনকি, তারা মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে  কালীপুজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য কর আদায় করত। শরীয়তউল্লাহ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং জমিদারদের এসকল অবৈধ কর প্রদান না করার জন্য তার শিষ্যদের নির্দেশ দেন। জমিদার গণ ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরু জবাইয়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। গরু কোরবানি করা মুসলমানদের প্রচলিত ধর্মীয় প্রথা এবং মুসলমানদের খাদ্য হিসেবে অন্যান্য মাংসের তুলনায় গরুর মাংসের মূল্য কম বিধায় শরীয়তউল্লাহ এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার জন্য মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেন।

কলকাতার সংবাদপত্র এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনাকালে ফরায়েজীদের বিদ্রোহী ভাবাপন্ন দল হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচারাভিযান শুরু করে। ১৮৩৭ সালে জমিদারগণ শরীয়তউল্লাহকে তিতুমীর এর ন্যায় একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তারা ফরায়েজীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করে এবং এ কাজে তারা ইউরোপীয় নীলকরদের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করে। কিন্তু তাদের অভিযোগসমূহ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হওয়ায় কোন অভিযোগই আদালতে প্রমাণ করতে পারে নি। অবশ্য ফরিদপুরে শান্তিভঙ্গ ও গোলযোগ সৃষ্টির অভিযোগে ১৮৩৯ সালে শরীয়তউল্লাহ একাধিকবার পুলিশি হেফাজতে ছিলেন।

১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র মুহসীন উদ্দীন ওরফে দুদু মিয়াকে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা ঘোষণা করা হয়। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তো সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রণোদিত একটি জমিদার শ্রেণি গড়ে তোলে। প্রজাদের কাছ থেকে জোর করে যতটা সম্ভব অর্থ আদায় করা ছাড়া অপর কোন চিন্তাই তাদের ছিল না। তারা বহুসংখ্যক লাঠিয়াল পুষত এবং তাদের সাহায্যে প্রজাদের উপর নির্যাতন চালাত।

এ ব্যবস্থা জমিদারদের বস্ত্তত সামন্তাধিকার প্রদান করে এবং কৃষক শ্রেণিকে প্রায় ভূমিদাসে পরিণত করে। কলকাতার আদালত ছিল দরিদ্র কৃষকদের আওতার বাইরে। জমিদারদের যৌক্তিক পথে আনার জন্য শক্তি প্রয়োগ ছাড়া দুদু মিয়ার আর কোন উপায় ছিল না। তিনি কানাইপুরের শিকদার পরিবার ও ফরিদপুরের ঘোষদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এরূপ এক সংঘর্ষে মদন ঘোষ নিহত হন। এর ফলে ১১৭ জন ফরায়েজী আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন এবং তাদের মধ্যে ২২ জন দায়রা জজ কর্তৃক ৭ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন। দুদু মিয়া সহ অন্যান্যরা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।

দুদু মিয়ার এই প্রাথমিক বিজয় জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাদের কাছে তাঁর সম্মান অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ঘটনাপ্রবাহ ফরায়েজী আন্দোলনের প্রসারে আরও প্রেরণা যোগায়। এতদিন যেসব মুসলমান আন্দোলন থেকে দূরে ছিল শুধু তারাই যে এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তা নয়, জমিদারদের বিরুদ্ধে দুদু মিয়ার সাহায্য লাভের জন্য হিন্দু ও দেশীয় খ্রিস্টানগণও এ আন্দোলনে যোগ দেয়।

জমিদারদের প্ররোচনায় এন্ড্রু ডানলপ্ নামের একজন প্রভাবশালী নীলকর দুদু মিয়ার চরম শক্রতে পরিণত হয়। কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলাল নামের  এক মাড়োয়ারি হিন্দু পাঁচচরে ডানলপের নীলকুঠির গোমস্তা ছিলেন। ১৮৪৬ সালের অক্টোবর মাসে পাঁচচরের হিন্দু বাবুদের সঙ্গে মিলে আনুমানিক সাত-আটশ’ লোক নিয়ে কাঞ্জিলাল বাহাদুরপুরে দুদু মিয়ার বাড়ি আক্রমণ করেন। দুদু মিয়ার অভিযোগ মতে তারা সামনের দরজা ভেঙে ফেলে, চার জন পাহারাদারকে হত্যা করে এবং অন্যান্যদের মারাত্মকভাবে জখম করে নগদ অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ কেড়ে নেয়। ঘটনাটি পুলিশকে জানালে হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে শুধুমাত্র আহত ব্যক্তিদের বিচারার্থে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রেরণ করেন।

ডানলপের গোমস্তা কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলালের সঙ্গে এ সংঘর্ষের কারণে দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করে দায়রায় সোপর্দ করা হয়। দায়রা আদালত দুদু মিয়া ও তার ৪০ জন অনুসারীকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করে। কিন্ত প্রদত্ত গুরুদন্ড এ আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় রায়টি অনুমোদনের জন্য কলকাতায় সদর নিজামত আদালতে প্রেরণ করা হয়। সদর নিজামত আদালত ফরিয়াদির অভিযোগের বর্ণনা অংশত চরম অবাস্তব এবং অংশত একদম অবিশ্বাস্য বলে মনে করে। ফলে তারা সবাই খালাস পেয়ে যান। দুদু মিয়ার অনুসারিগণ একে নিপীড়িত কৃষককুলের জন্য এক মহাবিজয় বলে স্বাগত জানায়।

১৮৬২ সালে দুদু মিয়া মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার নাবালক পুত্র গিয়াসউদ্দীন হায়দার ও আবদুল গফুর ওরফে নয়া মিয়ার তত্ত্বাবধানের জন্য একটি অভিভাবক পরিষদ গঠন করেন। এ দুই পুত্র পরপর ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। পরিষদ ক্ষীয়মান আন্দোলনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। নয়া মিয়ার বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে এবং তার নেতৃত্বে আন্দোলন হারানো শক্তি কিছুটা ফিরে পায়। মাদারীপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক নবীনচন্দ্র সেন বিচক্ষণতার সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তিতে ফরায়েজী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তোলেন। ফরায়েজী নেতৃবৃন্দও তাদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করে।

১৮৮৪ সালে নয়া মিয়ার মৃত্যুর পর দুদু মিয়ার তৃতীয় ও কনিষ্ঠতম পুত্র সৈয়দউদ্দীন আহমদ ফরায়েজীদের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর সময়ে তাইয়ুনি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফরায়েজীদের সংঘর্ষ চরমে পৌঁছে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় বিতর্ক পূর্ববঙ্গে নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। সরকার সৈয়দউদ্দীনকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এর প্রশ্নে তিনি বিভাজনের পক্ষে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। কিন্তু ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

খান বাহাদুর সৈয়দউদ্দীনের পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র রশিদউদ্দীন আহমদ ওরফে বাদশা মিয়া ফরায়েজী নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর নেতৃত্বের প্রথমদিকে বাদশা মিয়া সরকারের প্রতি সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ তাকে ব্রিটিশ বিরোধী করে তোলে এবং তিনি খেলাফত ও অসহযোগী আন্দোলনে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি নারায়ণগঞ্জে ফরায়েজীদের এক সম্মেলন আহবান করে পাকিস্তানকে ‘দারুল ইসলাম’ বলে ঘোষণা করেন এবং তার অনুসারীদের জুমআ ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করেন।

ফরায়েজীগণ তাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মানুশীলনে কতিপয় স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যসহ হানাফি মযহাবের অনুসারী ছিল। ঐ বৈশিষ্ট্যগুলিকে মোটামুটি পাঁচটি ফরায়েযী মতবাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়:
১. তওবা অর্থাৎ আত্মার পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে অতীত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।
২. ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ কঠোরভাবে পালন করা। ৩. কুরআন নির্দেশিত তৌহিদ বা একেশ্বরবাদ।
৪. ভারতবর্ষ ‘দারুল হরব’ বিধায় এখানে জুমআ ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠান অত্যাবশ্যকীয় নয়।
৫. কুরআন ও সুন্নাহ বহির্ভূত সকল লোকাচার ও অনুষ্ঠানকে ‘বিদাত’ বলে পরিহার করা।
পীর ও ‘মুরিদ’ অভিধার পরিবর্তে ফরায়েজীদের নেতাকে ‘ওস্তাদ’ বা শিক্ষক এবং তার অনুসারীদের ‘শাগরিদ’ বা শিষ্য বলা। ফরায়েজী জামায়াতে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিকে ‘তওবার মুসলিম’ বা ‘মুমিন’ বলা।

ফরায়েজীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে দুদু মিয়ার দুটি লক্ষ্য ছিল: ১. হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার থেকে ফরায়েজী কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষা করা এবং ২. জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য তিনি এক স্বেচ্ছাসেবক লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন এবং তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি অর্জনের জন্য তিনি ফরায়েজীদের নেতৃত্বে সনাতন স্থানীয় সরকারব্যবস্থা (পঞ্চায়েত) পুনঃপ্রবর্তন করেন। প্রথমোক্তটি ‘সিয়াসতি’ বা রাজনৈতিক শাখা এবং পরেরটি ‘দ্বীনি’ বা ধর্মীয় শাখা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ দুটি শাখা একীভূত করে ‘খিলাফত’ ব্যবস্থার রূপ দেওয়া হয়।

ফরায়েজী খিলাফত পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল সকল ফরায়েজীকে দুদু মিয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের (খলিফা) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা। খলিফাদের এই পরম্পরায় সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ‘ওস্তাদ’ দুদু মিয়া। তিনি তিন পদমর্যাদার খলিফা নিয়োগ করেন: উপরস্থ খলিফা, তত্ত্বাবধায়ক খলিফা ও গাঁও খলিফা।

দুদু মিয়া ফরায়েজী বসতি এলাকাকে ৩০০ থেকে ৫০০ পরিবারের এক একটি ছোট এককে বিভক্ত করেন এবং প্রতি এককে একজন গাঁও বা ওয়ার্ড খলিফা নিযুক্ত করেন। অনুরূপ দশ বা তদোধিক একক নিয়ে একটি সার্কেল বা গির্দ গঠিত হতো। প্রতিটি সার্কেল বা গির্দে একজন করে তত্ত্বাবধায়ক খলিফা নিয়োজিত হতেন। তত্ত্বাবধায়ক খলিফাকে একজন পিয়ন ও একজন পেয়াদা বা পাহারাদার দেওয়া হতো। এই পিয়ন ও পেয়াদারা একদিকে তত্ত্বাবধায়ক খলিফার সঙ্গে গাঁও খলিফাদের এবং অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক খলিফা ও ওস্তাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত। ‘উপরস্থ খলিফা’গণ ছিলেন ওস্তাদের উপদেষ্টা এবং তারা ফরায়েজী আন্দোলনের প্রধান কার্যালয় বাহাদুরপুরে ওস্তাদের সঙ্গে অবস্থান করতেন।

গাঁও খলিফা একজন সমাজপতির ভূমিকা পালন করতেন যার দায়িত্ব ছিল ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তার, ধর্মীয় কর্তব্য পালনে লোককে উদ্বুদ্ধ করা, খানকাহও মসজিদ সংরক্ষণ, নৈতিকতা পর্যবেক্ষণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচারকার্য সম্পন্ন করা। কুরআন শিক্ষা এবং ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের লক্ষ্যে একটি মকতব পরিচালনাও তার দায়িত্ব ছিল। তত্ত্বাবধায়ক খলিফার প্রধান দায়িত্ব ছিল গাঁও খলিফাদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করা, তার অধীনস্থ গির্দের ফরায়েজীদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখা, ধর্মের মৌলনীতি প্রচার এবং সর্বোপরি গাঁও খলিফাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোন আপিল মামলার নিষ্পত্তি করা। এরূপ ক্ষেত্রে তিনি তার গির্দের খলিফাদের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদে বসে আপিল মামলার শুনানি গ্রহণ করতেন। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সকল বিষয়ে দুদু মিয়ার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত এবং ওস্তাদ হিসেবে তিনি চূড়ান্ত আপিল আদালত হিসেবে কাজ করতেন।

ফরায়েজী আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক দিক হলো নবসৃষ্ট জমিদারদের নিপীড়ন প্রতিরোধের জন্য জনগণের একটি সুসংগঠিত পদক্ষেপ। এতে জমিদার ও নীলকরদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষক সম্প্রদায়ের অসন্তোষের তীব্রতার প্রতিফলন ঘটেছে। এটি ছিল জনতার কাতার থেকে এক ধরনের সফল নেতৃত্ব গড়ে উঠার একটি উদাহরণ।

লেখকঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) এমএসএস (অর্থনীতি)।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

স্বাধীনতার প্রথম উদিত সূর্য "শহীদ মঙ্গল পান্ডে"

স্বাধীনতার প্রথম উদিত সূর্য  "
শহীদ মঙ্গল পান্ডে"

শহীদ মঙ্গল পান্ডের জন্ম ১৯ জুলাই, ১৮২৭ আর মৃত্যু  ৮ এপ্রিল, ১৮৫৭। তার আদি বাড়ি ছিল উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার নাগওয়া গ্রামে।
ইংরেজ কোম্পানি সরকারের বিরোদ্ধে সিপাই বিদ্রোহ বা জাতীয় মহাবিদ্রোহের প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল মঙ্গল পান্ডের হাত ধরে,কলকাতার উপকন্ঠে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরে। সিপাইদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ইংরেজ বিরোধী অভ্যুত্থানের ডাক দেন সিপাই মঙ্গল। বিদ্রোহী মঙ্গলকে নিবৃত্ত করতে আসা দুই ইংরেজ অফিসার অ্যাডজুট্যান্ট লেফটেন্যান্ট বাগ এবং সার্জেন্ট মেজরকে প্রকাশ্যে হত্যা করে বিদ্রোহের সূচনা করেন।  ইংরেজ বাহিনী কর্তৃক ঘেরাওয়ের পূর্বমুহূর্তে আত্মসমর্পনের বদলে বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল মঙ্গল পান্ডে, পরে গুলিবিদ্ধ মঙ্গল পান্ডেকে হসপিটালে ভর্তি করেন ইংরেজ সরকার। সুস্থ হওয়ার পর প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয় ১৮৫৭ সালের ৮ এপ্রিল। ইংরেজ অফিসারদের আদেশ অমান্য করা ও মঙ্গল পান্ডেকে নিবৃত্ত না করে সহযোগীতার অপরাধে অপর এক ভারতীয় সিপাই ঈশ্বরী প্রসাদ পান্ডেকে ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ, রোববার অপরাহ্নে বারাকপুর সৈনিক নিবাসে ফাঁসি দেয় ইংরেজ সরকার।

কলকাতার ব্যারাকপুরে সিপাইদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ইংরেজ বিরোধী অভ্যুত্থানের প্রথম প্রকাশ্যে ডাক দিয়েছিলেন সিপাই মঙ্গল পান্ডে।
মঙ্গল পান্ডে প্যারেড গ্রাউন্ডের সমস্ত সেপাইদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন, “ভাইসব, আর সময় নেই! যদি নিজেদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, ধর্ম ফিরিঙ্গীর হাতে দলিত করতে না চাও তবে এগিয়ে এস। ধর কৃপাণ!”

“বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো ভাইসব। ফিরিঙ্গীর পায়ের তলায় আর কতদিন পড়ে থাকবে! ওরা আমাদের সোনার দেশ লুটেপুটে খাচ্ছে, আর আমরা না খেয়ে মরছি। ওরা আমাদের ধর্মের উপর হাত দিয়েছে, আমাদের জাতিভ্রষ্ট করছে। ভাইসব ফিরিঙ্গীদের মারো, একটা একটা করে সব ব্যাটাকে মারো; ফিরিঙ্গীদের খতম করে দেশকে স্বাধীন কর”।

মঙ্গল পাণ্ডে ব্যারাকপুরে এভাবেই সিপাহী বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। যে বিদ্রোহ খুব শীঘ্রই মিরাট, দিল্লি এবং ভারতের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এটা সারা বাংলাদেশ জুড়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৫৭ সালের ১১ মে মিরাট থেকে তিনশ’ বিদ্রোহী সিপাই দিল্লি এসে ৪৯ জন ব্রিটিশ নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে এবং দিল্লির দখল হাতে নিয়ে বাহাদুর শাহ জাফরকে মুঘল সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে। সম্রাটকে তাঁরা এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ জানান। অবস্থার চাপে পড়ে তিনি রাজি হলেও কর্তৃত্ব থেকে গিয়েছিল সিপাইদের হাতে। যদিও সকল আদেশ-নির্দেশ তাঁর নামে, তাঁর সিল-মোহরসহ বেরিয়েছিল। সৈনিক ও মোঘলদের টানাপোড়নের মাঝে কয়েক মাসের মধ্যে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইংরেজরা দিল্লি পুনর্দখল করে এবং হাজার হাজার বিদ্রোহী সৈনিককে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।
১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং জেলখানা হতে সকল বন্দীদের মুক্তি দেয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ দখল করে নেয়। কোষাগার লুণ্ঠন করে এবং অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ভারতীয় সমাজে যে জুলুম-নিপীড়ন চালায় তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া ছিল এই ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ। যে বিদ্রোহের শুরুটা করেছিলেন মঙ্গল পান্ডে।

লেখনঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) এমএসএস(অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Sunday, May 5, 2019

বাংলাদেশে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রয়োজনঃ মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া

ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন, নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব কমানোর জন্য বাংলাদেশে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।

মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া
সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান,
বাংলাদেশ লেবার পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটি।