যখন প্রথম বাংলা ব্যাকরণ শিখা শুরু করলাম স্যার বললেন, মানুষ জন্ম বা সৃষ্টির পর থেকে ভাষা এসেছে। ভাষা হলো মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম, আর ভাষাকে প্রকাশ করার একটি মাধ্যম হলো বর্ণমালার লিখিত রুপ। ভাষার হাজার বছর পরে বর্ণমালা এবং তারও হাজার হাজার বছর পর ভাষাবিদেরা ভাষারীতি বা নীতিমালা প্রণয়ন করেন, যেটাকে আমরা ব্যাকরণ বলি। সুতারাং ভাষার জন্য বা ভাষার সহায়ক হলো ব্যাকরণ, ব্যাকরণের জন্য বা সহায়ক ভাষা নয়। বর্তমানে ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাকরণকে এমন বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে যে, ব্যাকরণ না জানলে ভাষা শিখা যায়না।
এই ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। তবে হা, ভাষা লিখিত রুপ প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যাকরণ কিছুটা সহায়ক হিসেবে কাজ করে বলতে পারেন। আমরা আমাদের শিশু সন্তানদের ভাষার লিখিত রুপ শিখানো ক্ষেত্রে কি প্রথমে ব্যাকরণ শিখাই ? উত্তর না। আবার প্রবাসীরা যখন আরব বা ইউরোপে ভাষা শিখে তখন কি ব্যাকরণ শিখে ? উত্তর না।
তাহলে আমরা বলতে পারি, ভাষার রুপগত আকারকে সুন্দর করার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ সহযোগী ভুমিকা পালন করে মাত্র। পৃথিবীতে এমন শতশত ভাষা আছে, যেটা ব্যাকরণ তো অনেক দূর, রুপগত আকার বা বর্ণমালা ও নেই। তাহলে আমরা বলতে পারি ভাষার প্রকাশ হলো মৌলিক ও প্রধান বিষয়। আর ব্যাকরণ হলো সহায়ক বিষয় মাত্র। অথচ মানুষ আসলটাকে বাদ দিয়ে নকলটা নিয়ে টানাটানি ও পারাপারি করে মহাব্যস্থ।
আজকের পৃথিবীতে প্রায় সাতশত কোটির একটু বেশি মানুষ বসবাস করে। যার অর্ধেরও বেশি নারী আর বাকিটা পুরুষ। এই পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির করে পাঠানোর আগে জ্বীন জাতিকে পাঠিয়েছেন। মানুষ পৃথিবীতে আসার আগেও এখানে জ্বীনেরা ছিল। পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া সব কিছুই মানুষের কল্যাণে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবী কে আল্লাহ মানুষের বসবাসের জন্য এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। কোন বিশেষ শ্রেনী বা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় বা আল্লায় বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী এমন কারো জন্য সৃষ্টি করেননি। কুরআনে বলা হয়েছে, মানুষের কল্যাণের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। আর ইসলাম হলো আল্লাহর মনোনীত ধর্ম মত বা পথ। ইসলাম ধর্মমত বা পথকে আল্লাহ মানব জাতির জন্য পছন্দ করে দিয়েছেন। তবে মানুষকে দুনিয়াতে মত বা পথ গ্রহণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন - আমি আল্লাহ যদি চাইতাম, সকল মানুষকে মুসলিম ও ইসলামকে দুনিয়াতে স্থায়ীভাবে কায়েম করতে পারতাম। এটা আমি করিনি কারণ আমি দেখতে চাই, তোমাদের মাঝে কারা আমাকে বিশ্বাস করে ও আমার দেওয়া বিধান মেনে চলে। তাহলে আমরা বলতে পারি, পৃথিবীর মৌলিক উপাদান হলো মানুষ, সকল মানুষ, এখানে কোন শ্রেনী বা বিশেষ গোষ্ঠির জন্য আল্লাহ পৃথিবী বা অন্য সব কিছু সৃষ্টি বা ইসলাম কে মনোনীত করেননি। মানুষ হলো মৌলিক উপাদান, আর অন্য সব প্রাণী বা জীবজন্তু বা ধর্ম মত বা পথ বা ইসলাম বা সব সৃষ্টি করেছে শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণে বা প্রয়োজনে। অথচ আজ মানুষকে গৌণ বিষয় আর ধর্মমত বা পথকে মৌলিক বিষয় বানিয়ে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। যে মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহ পৃথিবীকে সৃষ্টি করলো, ইসলাম ধর্মকে পাঠিয়েছে, এই মানুষ আজ ধর্মের নামে, পৃথিবী শাসনের নামে, পৃথিবীর ক্ষমতার জন্য, আরেক মানুষকে হত্যা করছে, মানুষ মানুষের উপর জুলুম করছে, নির্যাতন করছে, নিজ ধর্মমত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। মহান আল্লাহ তায়ালা, যিনি সকল জাহানের একমাত্র মালিক ও সৃষ্টিকারী, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করে দুনিয়াতে পাঠালেন এবং যিনি মানুষকে দুনিয়াতে পরীক্ষা করার জন্য স্বাধীন করে দিলেন তার সৃষ্টি মানুষকে আজ মানুষই ক্ষমতার জন্য, ধর্মের নামে, ইসলামের নামে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ধর্মমত বা পথ চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, এটা বিশ্বাস ও স্বেচ্ছায় মানা এবং পালন করার বিষয়। দুনিয়ার জীবনে আমরা যখন স্কুল বা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় বা চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দিই, তখন কি আমরা একজন আরেকজনকে লিখে দিই, বা আমরা কি অন্য কেমন পরীক্ষা হচ্ছে, সেটা নিয়ে ভাবি ? নাকি নিজের পরীক্ষা নিয়ে ভাবি?
অবশ্যই নিজে পরীক্ষা দেই এবং নিজেকে নিয়ে ভাবি। কারণ আমার কর্মফল আমাকে ভোগ করতে হবে। প্রশ্ন নিদিষ্ট আর উত্তর লেখার ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর ফলাফলে প্রশ্নের উত্তর অনুযায়ী পরীক্ষার পর ঘোষণা করা হবে।
দুনিয়াটা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, এখানে প্রত্যেক মানুষ পরীক্ষার্থী আর আল্লাহ সবাইকে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন ক্ষমতা দিয়েছে। আমরা মানুষ হয়ে কাউকে বাধ্য করতে পারিনা। তবে মানুষের কল্যাণময়ী হয়ে সঠিক পথে ডাকতে পারি। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা আল্লাহ কোন নবী বা রাসূলকে ও দেননি। পৃথিবী হলো পরীক্ষার হল, এখানে সবাই সমান সুযোগ পাবে এবং সময়ও সবার জন্য নিদিষ্ট। এখানে মানুষের নতুন নতুন ভাবনা আছে, চিন্তা আছে, মত বা পথ প্রকাশের ভিন্নতা থাকতে পারে। সবাই পাশ করবেনা, আবার সবাই ফেলও করবেনা এবং সমান নাম্বারও পাবেনা। এখানের পরিবেশে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতপার্থক্য মানুষের জন্মগত, আইনগত এবং মুক্তচিন্তা আর স্বাধীন মানসিকতার উর্বর ফসল। যারা মনে করে পৃথিবীর সকল মানুষ একই চিন্তা আর বিশ্বাসের আলোকে চলবে বা পরিচালিত হবে, তাদের চিন্তার গোড়াতে গলদ আছে বলে আমি মনে করি। যারা স্রষ্টাতে বিশ্বাস করে বা ইসলাম ধর্মের অনুসারী, তারা এমনটা কোন ভাবেই বিশ্বাস করার কারন থাকতে পারেনা। আল্লাহ দুনিয়াতে মানুষকে চিন্তা, বিশ্বাস আর মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার পাশাপাশি, নিজের জীবন নিজের মত করে পরিচালিত করারও স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিনি আল্লাহ যদি চাইতেন, তাহলে সবাইকে ইসলামের অনুসারী এবং পৃথিবীতে ইসলামকে একমাত্র পথ ও মত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তা করেননি, তিনি দুনিয়াতে মানুষকে মত ও পথ গ্রহণে স্বাধীনতা দিয়েছে। কাউকে জোর করে বা বাধ্য করে মতামত বা পথ চাপিয়ে দেননি। ধর্ম বা বিশ্বাস মানুষ পৃথিবীতে আসার আগেও ছিল, এখনও আছে। পৃথিবী পূর্ণ আয়ুতে থাকবে। যতদিন থাকবে, ততদিন মতপার্থক্য ও থাকবে।
মতপার্থক্যের জন্য মানুষ মানুষকে হত্যা করা বা জুলুম করা মানুষের মানবিক গুণ হতে পারেনা। মানুষ সৃষ্টির সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও সম্মানি প্রাণী । যারা অন্য সকল প্রাণীর নিয়ন্ত্রক ও পরিচালকের আসনে রয়েছে। মানুষ নিজেকে মহান বা উত্তম দাবি করেন এই যুক্তিতে যে , মানুষ হলো মানবিক ও সহনশীল আচরণকারী অতি বুদ্ধিমান যুক্তিশীল। মতপার্থক্য বা পথের পার্থক্যের কারণে মানুষের আচরণ অমানুষের মত হতে পারেনা। স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে দুনিয়াতে মত ও পথে স্বাধীনতা দিয়েছে, আর সৃষ্টি চায় সৃষ্টিকে দুনিয়াতে নিয়ন্ত্রক হয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে। এটা কেমন কথা ? মতের প্রচার আপনি করতে পারেন, মানুষকে প্রেম, দয়ার আর আপনার ধর্ম মতের পথে ডাকতে পারেন, আপনার চিন্তার কথাও বলতে পারেন। কিন্তু কাউকে মানতে বা পালন করতে বাধ্য করতে পারেননা, আপনি বাধ্য করার কে?
যে আল্লাহ বাধ্য করার ক্ষমতা রাখেন, তিনিতো বললেন- আমি দুনিয়াতে কাউকে চিন্তা ও পথ গ্রহণে বাধ্য করিনা, এটা দুনিয়া আমি স্রষ্টার উদারতা আর সৃষ্টির পরীক্ষার জায়গা। মানুষ হয়ে স্রষ্টার আইন লঙ্গন করে নিজে স্রষ্টার সৃষ্টিকে হত্যা করা মহা অন্যায় ও অনিয়ম। কর্ম আর কর্মী পৃথিবীতে আপন অধিকার এমন ভাবে ভোগ করবে, যেন অন্যের অধিকারে কোন ধরনের অসুবিধা না হয়। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ মুক্ত মনের মিছিলে স্বাধীন আর আনন্দের সাথে যুক্ত হয়ে শান্তির পথে চলতে হবে। মায়ের বুকে শিশুর নিরাপদ আশ্রয়ের মত করে পৃথিবীকে শান্তি আর সুন্দর নিরাপদ শহর বানাতে হবে। প্রেম, দয়া, সহানুভূতি, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা হবে মানুষের পরম ধর্ম। মানবিকতা আর জীবে ভালোবাসা সবার আগে। অহিংসা মন্ত্রে অহংকার কে জ্বলতে দিতে হবে। মানুষের মিছিলে শ্লোগান হবে- "মুক্তচিন্তায় শান্তির পথ"। এখানে শান্তির জীবন প্রতিষ্ঠা করা সকল ধর্মের বা সকল মত পথের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। এখানে সকল মানুষ রক্ত মাংসে গড়া আল্লাহর সৃষ্টি। সকল সৃষ্টির বেচে থাকা আর জীবনকে ভোগ করার অধিকার রয়েছে।
লেখকঃ
মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস (অনার্স) এমএসএস-অর্থনীতি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।