Thursday, May 16, 2019

শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লাহ আমাদের চেতনার অনুপ্রেরণাঃ (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লাহ আমাদের স্বাধীনতার অনুপ্রেরণাঃ  (মুহাঃ মহসীন ভূঁইয়া)

শহীদ তিতুমীর, যাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী (জন্ম ২৭শে জানুয়ারী ১৭৮২, মৃত্যু ১৯শে নভেম্বর,১৮৩১) তার পিতার নাম সৈয়দ মীর হাসান আলী ও মাতার নাম আবিদা রুকাইয়া খাতুন। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ও কৃষক প্রজার নেতা। ওয়াহাবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এই মহান বিপ্লবী । জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরূদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও বাঁশের কেল্লার নির্মাণের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় এই বাঁশের কেল্লাতেই ১৯ নভেম্বর ১৮৩১ সালে ৪৯ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান এবং সেখানে স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে (১৮২৭) তিতুমীর তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে 'তাহ্‌বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত 'দাঁড়ির খাজনা' এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। আগেই তিতুমীর পালোয়ান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন।
তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় পাঁচ হাজারে গিয়ে পৌঁছায় এবং তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়।
১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসাতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেল বাড়িয়া গ্রামে বাঁশ ও কাদা দিয়ে তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন।

তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। ঐ বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন, "ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।"১৪ নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের আক্রমণ করে। তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। ১৪শে নভেম্বর তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তাঁর বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
অনেক ঐতিহাসিক তিতুমীরের লড়াইকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় আখ্যা দেন কারণ মূলত হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতু যুদ্ধঘোষণা করেছিলেন। একথা সত্য তিতুমীর প্রজাদের একজোট করেছিলেন ধর্ম এবং জেহাদের ডাক দিয়েছেন। অত্যাচারী হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে আক্রমন, দেবনাথ রায় হত্যা, গো হত্যা ইত্যাদির উদাহরণ হিসেবে টানা যায়। অপরপক্ষে অমলেন্দু দে'র ভাষায় তিতুমীরের লক্ষ্য ও পথ ছিল ইসলামে পূর্ন বিশ্বাস এবং হিন্দু কৃষকদিগকে সাথে নিয়ে ইংরেজ মদতপুষ্ট জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা। তিতুমীরের আক্রমের লক্ষ্যবস্তু হিন্দুদের পাশাপাশি ধনী মুসলমানও ছিল। তার বক্তৃতা শোনার জন্যে দলে দলে হিন্দু মুসলিম কৃষক জমা হতো। তিতুমীরের এই সংগ্রাম ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ যার অভিমুখ ছিল অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবরা। শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লার আন্দোলন ছিল,এক কথায় ভারতবর্ষে ইংরেজ, জমিদার ও হিন্দু মহাজনদের অত্যাচারের বিরোদ্ধে কৃষক জনতার স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলন। যে ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ এ আমরা স্বাধীনতার প্রথম সোফান অর্জন করেছি।

মুহাম্মদ মহসীন ভূঁইয়া
বিএসএস(অনার্স)এমএসএস(অর্থনীতি)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments:

Post a Comment